
ডেস্ক রিপোর্ট
অশান্ত লাদাখে সরকারের কড়া পদক্ষেপ, চাপে সোনম ওয়াংচুক
লাদাখের সাম্প্রতিক উত্তেজনা নিয়ন্ত্রণে নিতে পুরনো কৌশলেই এগোচ্ছে মোদি সরকার। বুধবার লেহ-তে প্রাণঘাতী সংঘর্ষের পর, যাঁকে ঘটনার মূল প্ররোচক হিসেবে দেখা হচ্ছে, সেই পরিবেশ আন্দোলনকর্মী ও শিক্ষাবিদ সোনম ওয়াংচুকের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বিরুদ্ধে বিদেশি অনুদান আইনে (FCRA) লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে বাতিল করা হয়েছে লাইসেন্স। শুরু হয়েছে সিবিআই তদন্তও। প্রশাসনের একটি সূত্র জানিয়েছে, তাঁকে খুব শীঘ্রই গ্রেপ্তারও করা হতে পারে।
যদিও দীর্ঘদিন ধরে শান্তিপূর্ণ পথে লাদাখের দাবি নিয়ে আন্দোলন চালিয়ে এসেছেন ওয়াংচুক, এই প্রথম তাঁর আন্দোলনে হিংসা ছড়াল। বুধবার পৃথক রাজ্যের দাবিতে মিছিলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারান চারজন, আহত হন ৮০ জন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সাফ জানিয়েছে, এই সহিংসতায় উসকানি দিয়েছেন সোনম ওয়াংচুক।
বিভিন্ন মহলে কানাঘুষো, পাকিস্তানি জলবায়ু সম্মেলনে ওয়াংচুকের অংশগ্রহণ এবং এরপর থেকে তাঁর দাবিগুলোর ধারালো হয়ে ওঠার মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে। উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের দাবি, ইসলামাবাদে অনুষ্ঠিত ‘ব্রিদ পাকিস্তান’ সম্মেলনে যোগদানের পর থেকেই নতুন করে পৃথক রাজ্যের দাবি তুলেছেন তিনি। বিজেপির অভিযোগ, কংগ্রেসও এখন তাঁকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন করছে।
দীর্ঘকালীন শান্ত এলাকা, এবার উত্তপ্ত
লাদাখ, যা এতদিন জম্মু–কাশ্মীরের অংশ হয়েও তুলনামূলকভাবে শান্ত ছিল, সেখানে এই ধরনের হিংসা নজিরবিহীন। ১৯৮৯ সালে সামান্য সময়ের জন্য বৌদ্ধ-মুসলিম উত্তেজনা দেখা দিলেও, তারপর তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এলাকা ছিল শান্ত। এমনকি কাশ্মীরে যখন হিংসা তীব্র ছিল, লাদাখে তখনও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ছিল। কারগিল যুদ্ধে পাকিস্তানের সেনাপ্রধান মোশারফ চেষ্টা করেও লাদাখকে উত্তপ্ত করতে পারেননি।
কিন্তু এবার ছবিটা ভিন্ন। বৌদ্ধপ্রধান লেহ ও মুসলিমপ্রধান কারগিল—উভয় জায়গা থেকেই একই দাবি উঠেছে: পৃথক রাজ্যের মর্যাদা ও সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের আওতায় স্বশাসন। আন্দোলনের দিন কারগিলেও পূর্ণ বন্ধ পালিত হয়েছে। লাদাখের দুই প্রধান সম্প্রদায়—বৌদ্ধ ও মুসলিম—এবার প্রথমবারের মতো একজোট।
২০১৯ সালের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া
২০১৯ সালে জম্মু–কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা (অনুচ্ছেদ ৩৭০) বাতিল করে অঞ্চলটিকে ভাগ করে দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল—জম্মু–কাশ্মীর ও লাদাখ—তৈরি করে কেন্দ্র। জম্মু–কাশ্মীরের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে রাজ্য মর্যাদা ফিরিয়ে দেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হলেও, লাদাখকে স্থায়ীভাবে কেন্দ্রশাসিত রাখার সিদ্ধান্ত হয়।
প্রথমদিকে লাদাখবাসী কাশ্মীরি আধিপত্য থেকে মুক্তির কারণে খুশি থাকলেও, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের মধ্যে তৈরি হয় ক্ষোভ। তাঁরা চাইছেন ষষ্ঠ তফসিলের অধীনে স্বশাসন, আলাদা পাবলিক সার্ভিস কমিশন, আরও লোকসভা আসন, এবং সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সংরক্ষণ। যদিও এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রতিক্রিয়া এখনও অস্পষ্ট।
সোনম ওয়াংচুক: আন্দোলনের মুখ
‘থ্রি ইডিয়টস’–এর র্যাঞ্চো চরিত্রের বাস্তব প্রেরণা, সোনম ওয়াংচুক মূলত শিক্ষাবিদ ও পরিবেশপ্রেমী হিসেবে পরিচিত। ২০১৯ সাল থেকে লাদাখের পরিবেশ ও সংস্কৃতি রক্ষায় তিনি ক্রমাগত সোচ্চার। সরকারের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনায় দাবি তুলে ধরেছেন। অনশন, আন্দোলন, এমনকি দিল্লি অভিযানও করেছেন।
কিন্তু সম্প্রতি তিনি পৃথক রাজ্যের দাবিও যোগ করায় আন্দোলনের তীব্রতা বেড়ে যায়। গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি নতুন অনশনে বসেন। তাঁর জনপ্রিয়তা এতটাই যে, রাজনৈতিক দলের ঊর্ধ্বে উঠে তিনি লাদাখের জনতার একমাত্র প্রতিনিধি হয়ে ওঠেন।
সরকারের কৌশল ও প্রশ্নবিদ্ধ ভবিষ্যৎ
কেন্দ্রীয় সরকার তাঁর সংগঠনের লাইসেন্স বাতিল করে এবং তাঁর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছে: সোনমের তৎপরতা সহ্য করা হবে না। যদিও তিনি হিংসা প্রত্যাখ্যান করেছেন ও অনশন প্রত্যাহার করেছেন, সরকার তাঁকে ‘উসকানিদাতা’ হিসেবেই চিহ্নিত করছে।
যেখানে জম্মু–কাশ্মীর এখনও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়নি, সেখানে লাদাখও অশান্ত হয়ে উঠলে তা দেশের অখণ্ডতার জন্য অশনি সংকেত। তাই সরকার চাইছে যিনি আন্দোলনের প্রধান মুখ, তাঁকে চেপে ধরা হোক। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে—এভাবে কি লাদাখের মানুষের মন জয় করা যাবে?