
আন্তর্জাতিক ডেস্ক
গাজায় চলমান যুদ্ধ সম্পূর্ণ বন্ধ এবং ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহারের নিশ্চয়তা চায় হামাস। মিসরের শার্ম আল-শেখে দ্বিতীয় দিনের মতো অনুষ্ঠিত পরোক্ষ আলোচনার পর মঙ্গলবার এ তথ্য জানা যায়।
এর আগে যুদ্ধ শুরুর দ্বিতীয় বার্ষিকীতে হোয়াইট হাউসে দেওয়া বক্তব্যে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেন, গাজা নিয়ে সমঝোতার “বাস্তব সুযোগ” তৈরি হয়েছে। বুধবার থেকে আলোচনায় যোগ দিচ্ছেন কাতার ও যুক্তরাষ্ট্রের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা।
মঙ্গলবার দিনের শুরুতে হামাসসহ বিভিন্ন ফিলিস্তিনি গোষ্ঠীর জোট এক যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে জানায়, “সব উপায়ে প্রতিরোধ অব্যাহত থাকবে।” বিবৃতিতে আরও বলা হয়, “ফিলিস্তিনি জনগণের অস্ত্র কেড়ে নেওয়ার অধিকার কারও নেই”—যা ট্রাম্পের পরিকল্পনায় থাকা হামাস নিরস্ত্রীকরণের প্রস্তাবের সরাসরি প্রতিক্রিয়া বলে মনে করা হচ্ছে।
হামাসের জ্যেষ্ঠ নেতা ফাউজি বারহুম জানান, তাঁদের আলোচকরা যুদ্ধের স্থায়ী অবসান ও গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর “সম্পূর্ণ প্রত্যাহার”-এর নিশ্চয়তা চান। তবে ট্রাম্পের প্রস্তাবিত পরিকল্পনায় সেনা প্রত্যাহারের সময়সূচি নির্ধারিত নেই; বরং তা শুরু হবে তখনই, যখন হামাস তাদের হাতে থাকা ৪৮ জন ইসরায়েলি বন্দিকে ফেরত দেবে। ধারণা করা হয়, তাঁদের মধ্যে প্রায় ২০ জন এখনো জীবিত।
আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হামাসের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা জানান, গাজার সেনা প্রত্যাহারের ধাপ অনুযায়ী বন্দিমুক্তির প্রক্রিয়াও ধীরে ধীরে সম্পন্ন করতে চায় সংগঠনটি। মঙ্গলবারের আলোচনায় মূলত বন্দিমুক্তি ও সেনা প্রত্যাহারের কাঠামো নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা হয়। হামাসের দাবি, শেষ ইসরায়েলি বন্দি মুক্তির সঙ্গে সঙ্গেই গাজা থেকে শেষ ইসরায়েলি সেনারও প্রস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
হামাসের প্রধান আলোচক খালিল আল-হাইয়া মিসরের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন আল কাহেরা নিউজ-কে বলেন, “আমরা দখলদার শক্তির ওপর এক মুহূর্তের জন্যও ভরসা করি না।” তিনি যোগ করেন, ইসরায়েলের পূর্ববর্তী যুদ্ধবিরতি চুক্তি ভঙ্গের অভিজ্ঞতা থেকেই হামাস এবার ‘বাস্তব নিশ্চয়তা’ চায়।
অন্যদিকে, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আক্রমণের দুই বছর পূর্তিতে দেওয়া বিবৃতিতে বলেন, “এই সংঘাত আমাদের অস্তিত্ব ও ভবিষ্যতের জন্য এক যুদ্ধ।” তিনি যুদ্ধবিরতির প্রসঙ্গ না টেনে জানান, সব বন্দি মুক্তি, হামাসের প্রশাসনিক কাঠামো ধ্বংস এবং গাজাকে স্থায়ীভাবে ইসরায়েলের জন্য ‘অহুমকি অঞ্চল’ বানানোই তাঁদের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
তবে কূটনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, উভয় পক্ষই ট্রাম্পের প্রস্তাবের কিছু দিক গ্রহণ করায় আলোচনার সম্ভাবনা আশাব্যঞ্জক হয়ে উঠেছে।
কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মাজেদ আল-আনসারি জানান, কাতার, মিসর ও তুরস্ক—এই তিন মধ্যস্থতাকারী দেশ পরিস্থিতি অনুযায়ী নিজেদের অবস্থান নমনীয় রাখছে। তিনি বলেন, “আমরা কোনো পূর্বধারণা নিয়ে আলোচনায় যাই না; আলোচনার মধ্য দিয়েই কাঠামো গড়ে তুলি।”
তিনি আরও জানান, কাতারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মোহাম্মদ বিন আবদুররহমান আল থানি এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি স্টিভ উইটকফ ও জ্যারেড কুশনার বুধবারের আলোচনায় অংশ নেবেন। “প্রধানমন্ত্রীর অংশগ্রহণই প্রমাণ করে, মধ্যস্থতাকারীরা যুদ্ধের অবসান ঘটাতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ,” যোগ করেন আল-আনসারি।
তবে যুদ্ধ শেষ হলেও প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে—গাজা কে পরিচালনা করবে এবং পুনর্গঠনের ব্যয় কে বহন করবে। ট্রাম্প ও নেতানিয়াহু আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, হামাসকে কোনো প্রশাসনিক ভূমিকা দেওয়া হবে না। তাঁদের পরিকল্পনা অনুযায়ী, গাজা পরিচালনা করবে ফিলিস্তিনি “প্রযুক্তিবিদদের” একটি দল, যা আন্তর্জাতিক অস্থায়ী শাসন সংস্থা বোর্ড অব পিস-এর অধীনে কাজ করবে। তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে থাকবেন ট্রাম্প ও যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার।
অন্যদিকে, হামাসের মুখপাত্র ফাউজি বারহুম বলেন, যুদ্ধোত্তর পুনর্গঠন কার্যক্রম “একটি ফিলিস্তিনি জাতীয় সংস্থার তত্ত্বাবধানে” শুরু করতে হবে। হামাস জানিয়েছে, যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তারা গাজার প্রশাসনে অংশ নেবে না।
এদিকে আলোচনার মধ্যেই ইসরায়েল গাজায় বিমান ও ড্রোন হামলা অব্যাহত রেখেছে। মঙ্গলবার গাজা সিটি ও আশপাশের সাবরা ও তল আল-হাওয়া এলাকায় হামলায় অন্তত ১০ জন নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে ফিলিস্তিনি সরকারি সংবাদ সংস্থা ওয়াফা। চলমান যুদ্ধে মোট প্রাণহানি ছাড়িয়েছে ৬৬ হাজার ৬০০।
আল জাজিরার প্রতিবেদক হিন্দ খুদারি জানান, গাজার পূর্বাঞ্চলে এক কিশোরকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং দক্ষিণের খান ইউনিসে হামলায় আরও ছয় ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। তিনি বলেন, “সবাই শান্তিচুক্তির অপেক্ষায়, অথচ বোমা পড়া থামছে না।”
মার্কিন গবেষণা সংস্থা এসিএলইডি জানায়, গত দুই বছরে গাজায় ১১ হাজারেরও বেশি বিমান ও ড্রোন হামলা এবং ৬ হাজারের বেশি আর্টিলারি আক্রমণ চালানো হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত ১,৭০১ জন চিকিৎসাকর্মী প্রাণ হারিয়েছেন।