
অনুবাদ, ইউএনবি
বাংলাদেশে বিবাহবিচ্ছেদ আর বিরল কোনো ঘটনা নয়। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বৈবাহিক সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার হার নাটকীয়ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পারিবারিক সহিংসতা, যৌতুকের চাপ এবং পরকীয়ার মতো কারণগুলো বিবাহবিচ্ছেদের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে উঠে এসেছে।
বিচ্ছিন্ন পরিবার, বাস্তব ঘটনা ও বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টিভঙ্গি
গৃহস্থ সহিংসতা
নেহা (ছদ্মনাম), ২৮, একসময় গুলশানের এক বিত্তশালী পরিবারে বিয়ে করে সুখের সংসার গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলেন।
প্রথম কয়েক বছর শান্তিপূর্ণ কাটলেও সময়ের সঙ্গে পরিস্থিতি বদলে যায়।
“আমি একটি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে শিক্ষকতা করতাম। আমাদের পরিবার আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। কিন্তু শ্বশুর বলেছিলেন, চাকরির দরকার নেই, কারণ টাকা-পয়সার সমস্যা নেই। আমার স্বামী ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকায় রাত করে ফিরতেন এবং প্রায়ই মদ্যপান করতেন। ছোটখাটো ব্যাপারে রেগে যেতেন। প্রথমে ভেবেছিলাম, সময়ের সঙ্গে সব ঠিক হয়ে যাবে,” বলেন নেহা।
কিন্তু সহিংসতা ধীরে ধীরে চরম পর্যায়ে পৌঁছায়। অবশেষে তিনি সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নেন, যদিও মামলা করতে ভয় পেয়েছিলেন। “সাহস সঞ্চয় করতে অনেক সময় লেগেছে, তবে আমি জানতাম, আমার এর চেয়ে ভালো জীবন প্রাপ্য।”
নেহার গল্পটি ব্যতিক্রম নয়। পারিবারিক সহিংসতা এখনো বিবাহবিচ্ছেদের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে একটি, যা নারীদের শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে দেয়।
যৌতুকের অভিশাপ
যদিও যৌতুকপ্রথা আইনত নিষিদ্ধ, এটি এখনো সমাজে একটি ভয়াবহ ব্যাধি হিসেবে রয়ে গেছে। অনেক নারী এমন বিবাহে আবদ্ধ হন যেখানে তাদের স্বামী বা শ্বশুরবাড়ির লোকজন কেবল তাদের আর্থিক সম্পদ হিসেবেই দেখে।
সোহানা (ছদ্মনাম), ২৬, বর্ণনা করেন কীভাবে তার শ্বশুরবাড়ি তার বাবার দেওয়া ৬ লাখ টাকা ও স্বর্ণালংকার নেওয়ার পরও নতুন নতুন চাহিদা তুলতে থাকে।
“বিয়ের সময় বাবা অনেক কিছু দিয়েছেন। কিন্তু বিয়ের ১৫ দিনের মাথায় তারা আবার টেলিভিশন ও ফ্রিজের জন্য টাকা চাইতে এলেন। আমার পরিবার যা দেওয়ার ছিল, সবই দিয়েছে। কিন্তু আমার স্বামী চাপ দিতে থাকে, বললো, আমি টাকা দিতে না পারলে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেবে।”
কিছুদিনের মধ্যেই মানসিক নির্যাতন শারীরিক সহিংসতায় রূপ নেয়। শেষ পর্যন্ত সোহানা সংসার ছাড়েন এবং এখন চাকরির খোঁজ করছেন। “আমাদের পরিবার মধ্যবিত্ত। আগে চাকরি করতে চাইনি, কিন্তু এখন আমার সামনে আর কোনো পথ নেই।”
পরকীয়া: সম্পর্ক ভাঙনের শেষ ধাপ
একটি দাম্পত্য জীবনের ভিত্তি হলো বিশ্বাস, যা একবার ভেঙে গেলে সম্পর্ক আর টিকে থাকে না।
বর্তমানে বিবাহবিচ্ছেদের অন্যতম প্রধান কারণ পরকীয়া। এটি শুধু পুরুষদের মধ্যেই নয়, নারীদের মধ্যেও বাড়ছে।
সোনিয়া (ছদ্মনাম), ২৫, গর্ভাবস্থার সময় তার স্বামীর পরকীয়ার শিকার হন।
“আমি যখন সন্তানসম্ভবা হই, তখন পরিচর্যার জন্য মায়ের কাছে যাই। তখন জানতে পারি, আমার স্বামী অন্য নারীদের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছে। প্রথমে সে অস্বীকার করলেও, যখন আমি প্রমাণ দেখালাম, তখন সে আর লুকানোর চেষ্টাও করলো না। উল্টো আমাকে ত্যাগ করতে বললো,” বলেন সোনিয়া।
প্রথমে তিনি সবকিছু সহ্য করেছিলেন, কিন্তু যখন তার স্বামী কোনো আর্থিক দায়িত্বও নিতে চাইল না, তখন তিনি আইনের আশ্রয় নেন।
পুরুষরাও পরকীয়ার শিকার হন। কবির (ছদ্মনাম), ৪২, জানান, কীভাবে তার স্ত্রী পরকীয়ায় জড়িয়ে তার সংসার ভেঙে দেয়।
“দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পর আমার স্ত্রী একদম বদলে যায়। আমি লক্ষ্য করলাম, সে রাতে দেরি করে ঘুমায়, কোথায় যায় তা নিয়ে মিথ্যা বলে, সারাক্ষণ কারো সঙ্গে চ্যাট করে। আমি একদিন তাকে অনুসরণ করি, তারপর নিশ্চিত হই।”
এই সত্য জানার পর কবির মানসিকভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পড়েন। “আমি নিজের কথা ভাবিনি, শুধু সন্তানদের কথা ভেবেছি। আমার মেয়ে আমার সঙ্গে আছে, কিন্তু আমার চার বছরের ছেলে মায়ের সঙ্গে রয়ে গেছে। এটা আমার হৃদয় ভেঙে দেয়।”
বিশেষজ্ঞ বিশ্লেষণ: এক ক্রমবর্ধমান সংকট
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও মানবাধিকার কর্মী ব্যারিস্টার শুভ্রা চৌধুরী উল্লেখ করেন, “বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে চলেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে মানসিক নির্যাতন, পারিবারিক সহিংসতা এবং পরকীয়ার কারণেই সম্পর্ক ভাঙছে। এখন পরকীয়ার হার শুধু পুরুষদের মধ্যেই নয়, নারীদের মধ্যেও বেড়ে যাচ্ছে, যা অনেক সময় হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ ও আত্মহত্যার মতো চরম পরিণতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “যদি একটি সম্পর্ক বিষাক্ত হয়ে যায়, তাহলে তা ত্যাগ করাই উত্তম। অপরাধ বা সহিংসতার পথ বেছে নেওয়া উচিত নয়।”
আইন প্রয়োগ ও সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি
হাতিরঝিল থানার পরিদর্শক রাজু আহমেদ জানান, “অনেক গার্হস্থ্য সহিংসতার ঘটনা পুলিশের কাছে পৌঁছায় না। কিছু এলাকায় রাতের পার্টির পর পুরুষেরা বাসায় ফিরে এসে স্ত্রীর ওপর নির্যাতন চালায়, কিন্তু অনেক নারী সামাজিক লজ্জার কারণে অভিযোগ করেন না।”
বিবাহবিচ্ছেদ যদিও আইনত স্বীকৃত, তবে এটি এখনো বিশেষ করে নারীদের জন্য একটি সামাজিক কলঙ্ক হিসেবে রয়ে গেছে। আইন থাকলেও এর সঠিক বাস্তবায়ন সবসময় হয় না।
ব্যারিস্টার চৌধুরী বলেন, “শুধু আইন প্রণয়ন করলেই হবে না, সেগুলোর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। না হলে গার্হস্থ্য সহিংসতা ও যৌতুকজনিত নির্যাতন বন্ধ হবে না।”
অব্যক্ত ক্ষত
আইনগত ও আর্থিক সংকটের পাশাপাশি বিবাহবিচ্ছেদ মানসিকভাবেও বিপর্যস্ত করে তোলে, বিশেষ করে সন্তানদের জন্য এটি দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব ফেলে।
একটি সুস্থ সমাজ গঠনের জন্য পারিবারিক সহিংসতা, আর্থিক শোষণ এবং পরকীয়ার মতো সমস্যাগুলো সমাধানে সচেতনতা, আইনি সহায়তা ও সামাজিক পরিবর্তনের প্রয়োজন। কারণ, একটি সমৃদ্ধ সমাজের ভিত্তি হলো সুস্থ ও সম্মানজনক সম্পর্ক।