মাহির তাজওয়ার
লেখক, গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
নিত্যপণ্যের লাগামছাড়া মূল্যবৃদ্ধির ফলে নানা পেশাজীবীর মানুষ, শিক্ষার্থীসহ সাধারণ জনগোষ্ঠীর জীবন বিপন্ন হয়ে পড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রব্যের মূল্য যেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে, মানুষের আয় সমানুপাতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশের বেশির ভাগ মানুষ তাঁদের চাহিদা মেটাতে অক্ষম হয়ে পড়ছেন। প্রতি কেজি আলু ৭৫-৮০ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ১৩৫-১৪০, আমদানি করা পেঁয়াজ ১২০-১৩০, রসুন (দেশি) ২২০-২৪০ , বেগুন ১২০-১৩০, আদা (দেশি) ২২০-২৪০ ফুলকপি ৪০-৮০, লবণ (আয়োডিনযুক্ত) ৪২, চিনি ১৩০-১৪০, মসুর ডাল ১৩০-১৩৫, ব্রয়লার মুরগি ১৭০-১৮০, ডিম প্রতি ডজন ১৮০-১৯০, খাসির মাংস ১ হাজার-১ হাজার ১০০, গরুর গোশত ৭৫০-৭৮০ টাকা, সয়াবিন তেল প্রতি লিটার (খোলা) ১৬৯ ও শর্ষের তেল (বোতল) ৩৬০ টাকা। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখতে এবং পণ্যের দাম যাতে যৌক্তিক পর্যায়ে থাকে সেজন্য বাজার তদারকি করতে জেলায় জেলায় বিশেষ টাস্কফোর্স করেছে অন্তর্বর্তী সরকার, যা ইতোমধ্যেই কার্যকর হয়েছে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।(বিবিসি, ৮ অক্টোবর ২০২৪)। সরকার দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে টাস্কফোর্স গঠন থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরণের পদক্ষেপ নিচ্ছে কিন্তু আদতে জনগণ তেমন কোনো ফলাফল পাচ্ছে না। তাই দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির প্রকৃত কারণগুলোকে চিনহিত করা জরুরী হয়ে পড়েছে।
বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার অধীনে দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ হল পশ্চিমাদের আর্ন্তজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোঃ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও বিশ্বব্যাংকের পরামর্শসহ (যেমনঃ বেসরকারীকরণ নীতি, স্ট্রাকচারাল এডজাস্টমেন্ট প্রোগ্রাম) বিভিন্ন পুঁজিবাদী নীতিমালা বাস্তবায়ন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেঃ
১। আমদানি নির্ভরতা
এদেশের বিদ্যমান পুঁজিবাদী সরকারগুলো আইএমএফ ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের পরামর্শে কৃষি ও কৃষিপণ্যের উপর থেকে ক্রমাগতভাবে ভর্তুকী প্রত্যাহার করেছে এবং কৃষিখাতে স্বয়ংসম্পূর্ণতার কথা বললেও চাল, ডাল, তেল, নুন সহ সকল প্রকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের বাজারকে ভারত সহ অন্যান্য বিদেশী রাষ্ট্র থেকে উচ্চ মূল্যে আমদানির উপর নির্ভরশীল করে রেখেছে। ফলে পণ্যের দাম বাড়ছে । সরকার এসব পণ্য নিজে আমদানি না করে কতিপয় রক্তচোষা পুঁজিপতিগোষ্ঠীকে দেশের নিত্যপণ্যের বাজারের নিয়ন্ত্রণ প্রদান করেছে। যেমনঃ দেশে ৮৫ শতাংশেরও বেশি চিনি এবং আমদানি করছে দেশের তিন বড় শিল্পগোষ্ঠী মেঘনা, সিটি ও এস আলম গ্রুপ (বণিকবার্তা, জুন ১৯, ২০২২)। এবং ভোজ্যতেলের ৮৮% আমদানি করছে টিকে, মেঘনা, সিটি ও এস আলম—এ চার শিল্পগ্রুপ (বণিক বার্তা, ৬ মে ২০২২)। এই আমদানি নির্ভরতা এবং বাজারের উপর ব্যবসায়ীদের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। আর মূল্যবৃদ্ধির এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে কতিপয় বড় পুঁজিপতিরা বিপুল অংকের মুনাফা হাতিয়ে নেয়।
২। আমদানি পণ্যের উপর শুল্ক, ভ্যাটসহ বিভিন্ন প্রকার ছদ্মবেশী কর আরোপ
বিগত পুঁজিবাদী সরকারগুলো নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের উপর আমদানী শুল্ক, ভ্যাটসহ বিভিন্ন প্রকার ছদ্মবেশী কর আরোপ করে যার ফলে ভোক্তা পর্যায়ে পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। যেমনঃ সরকার ভোজ্য তেল ও চিনিসহ অন্যান্য বিভিন্ন আমদানি থেকে বিভিন্ন হারে পাঁচ ধরণের ট্যাক্স আদায় করে। এগুলো হচ্ছে আমদানি শুল্ক, রেগুলেটরি শুল্ক, মূসক, অগ্রিম কর এবং অগ্রিম আয়কর। এই ট্যাক্স কাঠামো এমনভাবে তৈরি করা যে পণ্যের দাম যত বাড়ে সরকারের আয় (ট্যাক্স) তত বাড়ে। অথচ সরকার এইসব ট্যাক্স আদায় বন্ধ করলে বিভিন্ন পণ্যদ্রব্যের দাম কেজি প্রতি ৩০-৪০ টাকা কমে যেত। যদিও অন্তবর্তী সরকার দ্বায়িত্ব নেয়ার পর বিভিন্ন আমদানি পণ্যে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ শুল্ক অব্যাহতি দিয়েছে কিন্তু নিত্যপণ্যের বাজারে এখনো স্বস্তি ফিরেনি। আমদানি পণ্যে সকল প্রকার শুল্ক ও কর অব্যাহতির দাবি উঠছে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে।
৩। মজুতদারী ও বাজার সিন্ডিকেট
বাংলাদেশের বাজারে জিনিসপত্রের দাম নির্ধারণে সিন্ডিকেটের ভূমিকা অস্বীকার করার কোন অবকাশ নেই। বাংলাদেশে কিছুদিন পর পর কোন না কোন পণ্য সিন্ডিকেটের খপ্পরে পড়ছে। কখনও মুরগী, পেঁয়াজ, আটা, সয়াবিন তেল, কাঁচা মরিচ, ডিম এমনকি ডাব ও রোগীকে দেয়া স্যালাইনও বাদ যাচ্ছে না। এক দল ক্ষুদ্রগোষ্ঠী বাজারে আধিপত্য বিস্তার করতে ইচ্ছামতো পণ্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করে এবং দাম বাড়িয়ে অবৈধভাবে মুনাফা অর্জন করে। পণ্যের উৎপাদনে কোনও ঘাটতি না থাকা এবং সরবরাহ ব্যবস্থা স্বাভাবিক থাকার পরও এই ক্ষুদ্রগোষ্ঠী পণ্য গুদামজাত করে এবং সংকটের কথা বলে বেশি দামে বিক্রি করে। দেশে ডিম, সয়াবিন তেল কিংবা পেয়াজের বাজারের অস্থিরতার কথা সবারই জানা আছে। এতে পণ্যদ্রব্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে যাচ্ছে। বাজার সিন্ডিকেট নামক এই ক্ষুদ্র পুঁজিপতিগোষ্ঠী বিগত পুঁজিবাদী সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রী-এমপিদের ঘনিষ্ট বলেও বিভিন্ন সময়ে প্রমাণিত হয়েছে এবং বিগত সরকারগুলো এসব পুঁজিপতিগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা না নিয়ে তাদেরকে বাজার থেকে বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেয়ার সুযোগ করে দিয়েছে। হাসিনা সরকার পতনের পরেও বাজারে নতুন সিন্ডিকেটের দৌড়াত্বের কথা শোনা যাচ্ছে।
৪। গণপরিবহনে চাদাবাজি
পণ্য পরিবহনে সরকারপন্থী কিংবা বিরোধী দলীয় নেতাদের বেশুমার চাঁদা আদায়ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির জন্য দায়ী। কৃষক পর্যায়ের সবজির পাইকারি মূল্যের সাথে রাজধানীর খুচরা বাজারে দামের পার্থক্য থাকে অন্তত কয়েকগুণ। কখনো কখনো তা ১০ গুণও ছাড়িয়ে যায়। এর পেছনে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখে পরিবহন ও পাইকারি বাজারের কয়েক স্তরের চাঁদাবাজি। (দ্যা বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড,১৭ আগস্ট, ২০২৪)। ব্যবসায়ী ও বাজার বিশ্লেষকরা মনে করছেন, শুধু চাঁদাবাজি বন্ধ হলেই পণ্যের দাম অন্তত ৩০ শতাংশ পর্যন্ত কমানো সম্ভব। (বণিক বার্তা, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪)। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের কারণে সড়ক ও ফুটপাতের চাদাবাজ গ্রুপগুলো ভেঙ্গে গেছে বলা হলেও দেশের বিভিন্ন স্থানে নতুন কয়েকটি চক্র পুনরায় সক্রিয় হচ্ছে বলে জানা গেছে।
৫। পুঁজিবাদী মুদ্রানীতি
পুজিবাদী মুদ্রানীতি দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে বিরাট ভূমিকা পালন করে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় সরকার নিজের ইচ্ছামত মুদ্রা ছাপাতে পারে। অতিরিক্ত টাকা ছাপানো ও ব্যাংক কর্তৃক ঋণ সৃষ্টির মাধ্যমে যখন টাকার সরবরাহ পণ্য ও সেবা উৎপাদনের চেয়ে বেশি হয় তখন মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয় এবং মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। আবার, দেখা যায় রফতানির তুলনায় আমদানি বেশি হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রা বিশেষ করে ডলারের চাহিদা বেশি থাকায় ডলারের বিপরীতে টাকার বিনিময় মূল্য কমে যায় ফলে আমদানিকৃত পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পায়। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অতিরিক্ত ৬০ হাজার কোটি টাকা ছাপানোর কারণে দেশ গত ১৫ বছরে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি ভেতর দিয়ে গিয়েছে।
ইসলাম কিভাবে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করবে?
বাজারে জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধির পিছনে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উপরোক্ত ত্রুটিসমূহ আলোচনার পর এবার আসুন আমরা ইসলাম দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি ও বাস্তব সমাধান নিয়ে আলোচনা করি। ইসলাম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যেখানে অর্থনীতি থেকে শুরু করে সামাজিক ন্যায়বিচারসহ রাষ্ট্র পরিচালনার সকল বিষয়ে সার্বিক দিক নির্দেশনা রয়েছে। ইসলামের রয়েছে স্বতন্ত্র একটি রাষ্ট্র কাঠামো এবং সরকার ব্যবস্থা । একমাত্র খিলাফত সরকারই অত্যন্ত দ্রুত ও কার্যকরভাবে দ্রব্যমূল্য উর্ধ্বগতির সমস্যা সমাধান করতে পারে এবং জনগণের অর্থনৈতিক উন্নতি নিশ্চিত করতে পারে। খিলাফত সরকার নিম্নোক্ত উপায়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করবে এবং জনগণের জীবনমান উন্নত করবেঃ
১। স্বনির্ভর অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করা
রাষ্ট্রের সকল নাগরিকদের জন্য ন্যায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলো নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের শারীয়াহ্ দায়িত্ব। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন, “ইমাম (খলিফা) হলেন অভিভাবক এবং তিনি তার নাগরিকদের ব্যাপারে দায়িত্বশীল” (বুখারী)। তাই বিশ্বব্যাংক ও আইএমফের মত পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানের পরামর্শে আমদানি নির্ভর পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিপরীতে রাষ্ট্রের খলীফা ইসলামী অর্থনীতির আলোকে স্বনির্ভর অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করবেন। এ লক্ষ্যে সরকার দেশের বিশাল উর্বর ভূমিকে ব্যবহার করে ব্যাপকভিত্তিক মৌলিক খাদ্যশস্য উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে মনোযোগ দিবে এবং একটি স্বনির্ভর কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা গড়ে তুলবে যাতে করে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের জন্য আমদানি নির্ভর না হতে হয়। কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য খলিফা প্রয়োজনে কৃষকদের বিনা মূল্যে বীজ, সার, প্রযুক্তি, এবং বায়তুল মাল থেকে আর্থিক অনুদান ও সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করবেন। এভাবে পণ্যদ্রব্যের ব্যাপক উৎপাদন ও সহজলভ্যতার ফলে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকরা ন্যায্য মূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্য ক্রয় করার সুযোগ পাবে।
২। মজুতদারী, বাজার সিন্ডিকেট ও একচেটিয়া ব্যবসার বিলোপসাধন
রাষ্ট্র বাজারকে কোন ক্ষুদ্র পুঁজিপতিগোষ্ঠীর মুনাফা অর্জনের হাতিয়ারে পরিণত করে না। মূল্য নির্ধারণ কিংবা মূল্যবৃদ্ধি শরীয়াহর দৃষ্টিতে হারাম হওয়ায় ইসলামিক ব্যবস্থায় সরকার কোন জিনিসের মূল্য নিজেও নির্ধারণ করে দিবে না কিংবা কোন ব্যক্তিকেও মূল্য নির্ধারণের এই সুযোগ প্রদান করে না। মাকাল ইবনে ইয়াসির (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন, “যে ব্যক্তি মুসলিমদের জন্য কোন পণ্যমূল্য বাড়ানোর ব্যাপারে কোনভাবে জড়িত থাকে, হাশরের দিনে তাকে ভয়ঙ্কর আগুনে নিক্ষেপ করা আল্লাহ্র জন্য বাধ্যবাধকতা হয়ে দাঁড়ায়। একই সাথে ইসলামী শারীআহ্ প্রতারণা ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মজুতদারীর মাধ্যমে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি সুস্পষ্টভাবে হারাম ঘোষণা করেছে। আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে প্রতারণা করে, সে আমাদের কেউ নয়।” (ইবনে মাজাহ ও আবু দাউদ)। এছাড়া সাইদ ইবনে আল মুসাইয়াব থেকে বর্ণিত যে মুয়াম্মার (রাঃ) বলেছেন যে রাসূল (সাঃ) বলেছেন, “যে মজুতদারী করে, সে অন্যায় করেছে।” (মুসলিম)। তাই খিলাফত সরকার সিন্ডিকেট, মজুতদারী ও সকল প্রকার একচেটিয়া ব্যবসা বিলুপ্ত করার জন্য প্রতিযোগিতামূলক বাজার ব্যবস্থা প্রণয়ণ করে এবং বাজারে পর্যাপ্ত পণ্য সরবরাহ এবং যথোপযুক্ত বাজার মনিটরিং এর ব্যবস্থা চালু করবে। এছাড়া সিন্ডিকেট, অসৎ ব্যবসা ও ভেজাল ইত্যাদি কঠোর হস্তে দমন করার জন্য রাষ্ট্রের বিচারক কাজী-উল-মুহতাসিব সব সময় বাজার পরিদর্শন করবেন ও তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নিবেন।যদি পণ্য স্বল্পতার কারণে বাজারে দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যায় তাহলে রাষ্ট্র অন্য কোন স্থান থেকে ঐ পণ্য সংগ্রহ করে বাজার সুলভ করার প্রানান্তকর প্রচেস্টা চালাবে। এভাবে রাষ্ট্র মূল্যবৃদ্ধিকে প্রতিহত করবে। খলীফা দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের (১৮৭৬-১৯০৯) শাসনামলে একবার রুটি ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটদের কারসাজিতে বাজারে রুটির দাম বেড়ে যায়। খলীফা বাজারে রুটির মূল্য স্থিতিশীল রাখার কৌশল হিসেবে তার প্রাসাদের সকল বাবুর্চি এবং সৈন্যদেরকে দিয়ে রাতভর রুটি বানানোর ব্যবস্থা করেন এবং পরের দিন ভোরবেলা রাজধানীর সব ঘরের সামনে রুটিগুলো রেখে আসার ব্যবস্থা করেন। এভাবে বাজারে রুটি সরবরাহ বৃদ্ধির মাধ্যমে খলীফা রুটির মূল্য বৃদ্ধিকে প্রতিহত করেছিলেন।
৩।ইসলামের মুদ্রানীতি
ইসলাম সরকারকে ইচ্ছামত টাকা ছাপানোর অনুমোদন দেয়না। ইসলাম টাকা ছাপানোর সুনির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয় নিয়ম প্রদান করেছে আর তা হলো স্বর্ণ ও রৌপ্যভিত্তিক মুদ্রা ব্যবস্থা। স্বর্ণ ও রৌপ্যভিত্তিক মুদ্রা ব্যবস্থায় সরকার নিজের ইচ্ছামত মুদ্রা সরবরাহ করতে পারেনা। এই মুদ্রানীতি অনুযায়ী স্বর্ণ ও রৌপ্য মজুদের বিপরীতে অর্থ মুদ্রিত হয়, তাই এই মুদ্রাব্যবস্থা মৌলিকভাবে স্থিতিশীল। রাসূলুল্লাহ্(সাঃ) ১ দিনার মুদ্রার জন্য ৪.২৫ গ্রাম স্বর্ণ এবং ১ দিরহামের জন্য ২.৯৭৫ গ্রাম রৌপ্য সংরক্ষণের নির্দেশ দিয়েছেন। যেহেতু স্বর্ণ ও রৌপ্যের মতো প্রাকৃতিকভাবে উৎপন্ন মূল্যবান ধাতুসমূহের সরবরাহ কৃত্রিমভাবে বাড়ানো সম্ভব নয়, সেহেতু স্বর্ণ ও রৌপ্য মান অনুযায়ী অর্থ মুদ্রণ কখনই স্বেচ্ছাচারপ্রসূত ও অবাধ হতে পারে না। তাই স্বর্ণ ও রৌপ্য ভিত্তিক মুদ্রা ব্যবস্থায় মুদ্রাস্ফীতি বলে কিছু নেই।এটি শুধু তত্ত্বকথা নয়, ইতিহাসের বাস্তবতা থেকে এর উদাহরণ দেয়া যেতে পারে: যেখানে প্রতি বছর আমাদের দেশে ৫-১০ শতাংশ করে মূল্যস্ফীতি ঘটছে, সেখানে উসমানী খিলাফতের একটি সুদীর্ঘ সময়, আশি বছরেরও অধিক সময়ের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ঘটেছে মাত্র ৭ শতাংশ।এভাবে সরকার কর্তৃক মূদ্রাস্ফীতির মাধ্যমে গরীবের সম্পদ লুট করার প্রক্রিয়া ইসলাম বন্ধ করে দেয়।
এভাবে ইসলাম দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে একটি সামগ্রিক সমাধান প্রদান করে। রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যই থাকবে সামগ্রিকভাবে একটি আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং গণমানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি নিশ্চিত করা। তাই শুধু বাংলাদেশের দরিদ্র, ক্ষুধার্ত ও বঞ্চিত মানুষের সমস্যা সমাধান নয়, সমগ্র বিশ্বের বঞ্চিত মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করবে রাষ্ট্র।