ডেস্ক রিপোর্ট:
আজ রবিবার (১৫ সেপ্টেম্বর) গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এসব কথা বলেন। তার পুরো বক্তব্য নিচে তুলে ধরা হলো:
সেই ধারাবাহিকতায়, ১৬ বছরের স্বৈরাচারী দুঃশাসনকে চূর্ণ করে, গত ৫ আগস্ট বাংলাদেশের জনগণ আবারও মুক্তির স্বাদ পায়, গণতন্ত্রের পথ সুগম করে। অসংখ্য ব্যক্তি ও পরিবার রয়েছে, যাদের বছরের পর বছর ধরে ত্যাগের মহিমায় আমরা ফ্যাসিবাদমুক্ত বাংলাদেশ পেয়েছি। বিভিন্ন প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘জুলাই গণহত্যায়’ ১৩ আগস্ট পর্যন্ত সমগ্র বাংলাদেশে শহীদ হন ৮৭৫ জন, যার মাঝে কমপক্ষে ৪২২ জন বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। দেশজুড়ে শহীদ হওয়া সকল শ্রেণি-পেশা-রাজনীতির মানুষগুলোর এ বিশাল অংশ যে বিএনপিরই নেতা-কর্মী – এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় – বরং আমাদের সুদীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের অনিবার্য ফল।
পোশাকশ্রমিক কিংবা রিক্সাচালক; পাবলিক কিংবা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র; বাম কিংবা ডান আদর্শের অনুসারী; সকল মত ও পথের রাজনৈতিক কিংবা অরাজনৈতিক ব্যক্তি – হতাহতের পরিচয় যাই হোক না কেন, প্রতিটি প্রাণের মূল্য ও রক্তের মর্যাদা সমান। আর তাই, সমান গুরুত্বের সাথেই প্রণয়ন করতে হবে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডের তালিকা ও নিশ্চিত করতে হবে সুবিচার। শেখ হাসিনার পদত্যাগের জন্য যে জাতীয় ঐকমত্য আমরা দেখতে পাই, তা কিন্তু হঠাৎ করে গড়ে ওঠেনি। এটি মূলত অবৈধ সরকারের অত্যাচার-অবিচার, দুর্নীতি-দুঃশাসন, বঞ্চনা-অবজ্ঞা, এবং শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে মানুষের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ।
দেশের প্রধান রাজনৈতিক দল হিসেবে, গণআকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে, গণঅভ্যুত্থানে সর্বশক্তি দিয়ে রাজপথে নেমে আসে বিএনপি এবং এর সকল অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন। আন্দোলনের কৃতিত্ব নিয়ে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল নয়, বিএনপির উদ্দেশ্য ছিল সর্বস্তরের নেতা-কর্মী-সমর্থকদের অংশগ্রহণে, গণঅভ্যুত্থানে সাংগঠনিকভাবে সর্বোচ্চ ভূমিকা রেখে, ফ্যাসিবাদের পতনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। আর তাই, বিএনপির যে ৬০ লক্ষ সদস্যের নামে ফ্যাসিবাদের সময় মিথ্যা মামলা হয়েছে, তার সুবিশাল অংশ সাধারণ মানুষের পাশে থেকে, রাষ্ট্রযন্ত্রের ষড়যন্ত্র ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে ঢাল হয়ে রুখে দাঁড়ায়। ফলে যার-যার অবস্থান থেকে জনগণের কাতারে নেমে আসে বিএনপি ও সমমনা সকল রাজনৈতিক দল, তথা গণতন্ত্রের পক্ষের শক্তিসমূহ।
১৬ জুলাই রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদকে নির্মমভাবে হত্যা করে পুলিশ; একই দিন চট্টগ্রামে চট্রগ্রাম কলেজ ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক ওয়াসিম আকরামকেও হত্যা করা হয়। এ হত্যাকাণ্ডগুলোতে সমগ্র বাংলাদেশ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে, বেগবান হয় আন্দোলন। ১৮ জুলাই ঢাকার উত্তরায় আন্দোলনে পানি বিতরণ করতে গিয়ে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের ছাত্র মীর মুগ্ধ; একই দিন যাত্রাবাড়ীতে পুলিশের গুলিতে নিহত হন ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছাত্রদল নেতা ইরফান ভূঁইয়া ও সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির ছাত্রদল নেতা ইমতিয়াজ আহমেদ জাবির।
এরই মাঝে, ১৭ জুলাই, বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ডিবি পুলিশের অভিযানের নামে মঞ্চায়িত হয় সাজানো নাটক, বলপূর্বক বন্ধ করা হয় কার্যালয়ের কার্যক্রম। বাসায়-বাসায় অভিযান চালিয়ে, বিএনপির অর্ধশত প্রথম সারির নেতাসহ ৩ হাজারের বেশি নেতা-কর্মীকে স্বল্প সময়ের মধ্যে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হন স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, এবং কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ রুহুল কবির রিজভী, জহিরউদ্দিন স্বপন, শহীদ উদ্দিন এ্যানী, শিমুল বিশ্বাস, আমান উল্লাহ আমান, রশিদুজ্জামান মিল্লাত, ডা. ফরহাদ হালিম ডোনার, ডা. রফিকুল ইসলাম, নাসিরউদ্দিন অসীম, সাইফুল ইসলাম নীরব, আমিনুল হক, সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, মীর নেওয়াজ, নিপুণ রায় চৌধুরী, ডা. শাখাওয়াত শায়ন্তসহ আরও অনেক সক্রিয় নেতা।
এ গণগ্রেফতার প্রমাণ করে যে, স্বৈরাচারের পতন ঠেকাতে আওয়ামী লীগ বরাবরের মতোই বিএনপিকে প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে চিহ্নিত করে, এবং আন্দোলনকে দমন করতে নিপীড়নের মাত্রা বাড়ায়। বহুমাত্রিক নিপীড়ন মোকাবিলা করেই বিএনপি নিরবিচ্ছিন্নভাবে রাজপথের অগ্রভাগে ছিল। বিশেষত, আগস্টের ৪ এবং ৫ তারিখে, নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে, শেখ হাসিনাকে পদত্যাগে বাধ্য করার সংগ্রামে জীবন দেন ঢাকা মহানগর পূর্ব ছাত্রদলের যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুর রহমান রাসেল, জালাল উদ্দিন ডিগ্রি কলেজের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আসিফ হোসেন, সোনারগাঁও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা রাসেল মাহমুদ, যশোর জেলা ছাত্রদল নেতা সাকিবুল হাসান মাহি প্রমুখ। এভাবে শুধু ছাত্রদল থেকেই, একে-একে কমপক্ষে ১১৩টি তাজা প্রাণ ঝরে পড়ে ছাত্র-জনতার সফল অভ্যুত্থানে।
সাভারের আশুলিয়ায় গুলি করে হত্যার পর, লাশগুলো ভ্যানে স্তূপ করে গানপাউডার দিয়ে পুড়িয়ে ফেলে পুলিশ, যার মধ্যে জাতীয়তাবাদী টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য সাজ্জাদ হোসেন সজলও ছিলেন। ক্ষমতা কুক্ষিগত রাখতে এ ধরনের বর্বরতা কেবল কিছু জীবনকে নিঃশেষ করা নয়, বরং মানবতার ওপর একটি গভীর আঘাত। শুধু তাই নয়, গণঅভ্যুত্থানের সময় পুলিশের গুলিতে শতাধিক বিএনপি নেতা-কর্মী দৃষ্টিশক্তি হারান, যার মধ্যে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলাতেই তুষার, হারেস, শাহজালালসহ ৬ জন রয়েছেন।
জুলাই-আগস্ট মাসে সমগ্র বাংলাদেশের এক দফা দাবি আর বিএনপির ত্যাগের পটভূমি সৃষ্টি হয়েছে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। উত্তাল রাজপথে এ পুরোটা সময় গুম-খুন, হামলা-মামলা, দমন-দুর্বৃত্তায়নের শিকার হয়েও, জনগণের প্রতিবাদের প্রতিনিধি হিসেবে রক্তস্নাত সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়ে এসেছে বিএনপি। রাজনৈতিক হয়রানির অংশ হিসেবে, গায়েবি মামলায় সর্বস্তরের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহিতা, হত্যা, নাশকতা, জঙ্গিবাদ, দুর্নীতিসহ নানা বানোয়াট ও মিথ্যা অভিযোগ দেওয়া হয়।
প্রহসনের মামলা ও সাজানো রায়ের মাধ্যমে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে আটক করে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা। অন্যায়ভাবে তার বাড়ি কেড়ে নিয়ে ভেঙে দেওয়া হয়, এবং নির্জন পরিত্যক্ত কারাগারে একমাত্র বন্দি হিসেবে রেখে, তাকে প্রাপ্য চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিরুদ্ধে ৫০টির বেশি বানোয়াট মামলা করা হয়। তার নির্বাসিত জীবনে বাকস্বাধীনতা হরণের পাশাপাশি, অবৈধভাবে চাকুরিচ্যুত করা হয় তার চিকিৎসক স্ত্রীকেও। একজন অরাজনৈতিক ব্যক্তি হওয়া সত্বেও তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলায় পাতানো সাজা ঘোষণা করা হয়। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধে অন্তত ৯৩টি মামলা দায়ের করা হয়। মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়সহ বিএনপির স্থায়ী কমিটির সকল সদস্যের বিরুদ্ধেও গণহারে গায়েবি মামলা করা হয়। এমনকি সালাহউদ্দিন আহমেদকে গুম করে দেশের সীমানা পেরিয়ে ভারতের মেঘালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়, এবং সেখানেই অসুস্থ অবস্থায় উদ্ধার হন তিনি। বিগত ১৭ বছরে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্যবৃন্দসহ অসংখ্য নেতা-কর্মী বিভিন্ন মেয়াদে কারাবরণ করেছেন।
হাজার-হাজার বিএনপি নেতা আছেন, যারা একেকজন শতাধিক মামলার বেড়াজালে আবদ্ধ। মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, এসএম জাহাঙ্গীর, রাজীব আহসানের মতো অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে ২০০-এর অধিক মামলা। সুলতান সালাউদ্দিন টুকু, রফিকুল ইসলাম মজনু, সাইফুল আলম নীরব, ইসহাক সরকারসহ অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে ৩০০-এর বেশি মামলা। হাবিব-উন-নবি সোহেলের বিরুদ্ধে রয়েছে রেকর্ড ৪৫১টি মামলা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও বিচার বিভাগকে ব্যবহার করে এমন অবিচার বিশ্বের অন্য কোথাও হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। গত এক দশক ধরে বিএনপির নেতা-কর্মীরা সপ্তাহের পাঁচ কার্যদিবস বিভিন্ন আদালতে হাজিরা দিয়ে এক অস্বাভাবিক জীবন কাটিয়েছেন। সকল অত্যাচার ও নির্যাতন সত্ত্বেও, নিজেদের জীবনকে উৎসর্গ করে তারা দেশের গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য অবিচলভাবে সংগ্রাম চালিয়ে গিয়েছেন।
এমনকি বিএনপির সেইসব নবীন কর্মী, যারা এখনো কোনো পদে আসেনি, শুধু বিএনপির আদর্শে বিশ্বাসী, তারাও রাজনৈতিক জিঘাংসার শিকার হয়েছে। তারুণ্যকে স্বপ্ন দেখানো এসব উদীয়মান নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে বানোয়াট মামলা দায়ের করে তাদের শিক্ষা ও কর্মজীবনকে ধ্বংস করে দিয়েছে। তাদেরকে রিমান্ডে নিয়েছে, বীভৎস নির্যাতন করেছে। কিন্তু অনেকের মতো টলাতে পারেনি আদর্শ থেকে, বের করতে পারেনি মিথ্যা স্বীকারোক্তি বা সাজানো বক্তব্য।
অস্বাভাবিক নিপীড়নের শিকার হয়ে ইলিয়াস আলী, সাইফুল ইসলাম হিরু, চৌধুরী আলম, হুমায়ুন পারভেজ, সাজেদুল ইসলাম সুমন, জাকিরসহ কেবল বিএনপির ৪২৩ জন নেতা-কর্মী এবং সকল রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ মিলিয়ে প্রায় ৭০০ জন গুম হয়েছেন। রাজধানীর খিলগাঁওয়ে ছাত্রদল নেতা নুরুজ্জামান জনিকে পুলিশ ১৫টি গুলি করে হত্যা করে; তার বুকে ও পেটের ক্ষতচিহ্নগুলো সেই নির্মমতার নীরব সাক্ষী হয়ে ছিল। চট্টগ্রামে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সহসাধারণ সম্পাদক নুরুল আলমের চোখ, হাত-পা বাঁধা লাশ পাওয়া যায় কর্ণফুলী নদীর তীরে। বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের সফল সংগঠককে রাতের আঁধারে যেভাবে হত্যা করা হয়, তা বর্বরতার কালো অধ্যায় হিসেবে ইতিহাসে থেকে যাবে।
কুমিল্লায় ছাত্রদল নেতা পারভেজ হোসেনকে হত্যা করে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা, আর ছাত্রলীগ-যুবলীগের গুলিতে শেরপুরের পাকুরিয়া ইউনিয়ন ছাত্রদল নেতা মাহবুব আলম নিহত হন। কারাবন্দি নাসিরুদ্দিন পিন্টু ও বিএম বাকির হোসেনকে হত্যার মাধ্যমে যে নৃশংস সংস্কৃতি সূচনা করে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা, তারই ধারাবাহিকতায়, রংপুরের লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মনোয়ারুল ইসলাম ও অন্তত ২০ জন বিএনপি নেতাকে নির্যাতনের মাধ্যমে কারাগারে খুন করা হয়। এসব হৃদয়বিদারক ঘটনায়, ২০১৩ থেকে ২০২৩ সালের মধ্যে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হন বিএনপির ১,৫৫১ জন নেতা-কর্মী। তাদের রক্তের ঋণ শোধ করতে হলে, আমাদেরকে যেকোনো মূল্যে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
ফ্যাসিবাদের সময় জুড়েই, বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা মধ্যযুগীয় নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। গাজীপুরের বোয়ালী ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি আলী আজম, যিনি মায়ের জানাজায় অংশ নিতে গিয়েছিলেন, তাকে হাতকড়া ও ডাণ্ডাবেড়ি বেঁধে ইমামতি করতে বাধ্য করা হয়। পটুয়াখালীর ছাত্রদল নেতা নাজমুল মৃধাকে বাবার জানাজায় ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে অংশগ্রহণ করানো হয়—একজন সন্তানের জন্য এর চেয়ে বড় গ্লানি আর কী হতে পারে?
জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে যশোর যুবদলের সহসভাপতি আমিনুর রহমান চিকিৎসাধীন অবস্থায় দুই পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরে মেঝেতে কাতরাচ্ছেন – এ দৃশ্য আজও জাতির বিবেককে তাড়িয়ে বেড়ায়। চট্টগ্রাম মহানগর ছাত্রদলের সহসাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলামকে তুলে নিয়ে, তার বাম পায়ে শটগান ঠেকিয়ে গুলি করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, যার ফলে পুরো পা কেটে ফেলতে হয়। ফ্যাসিবাদের দোসরদের অজস্র নৃশংসতা বিএনপির তৃণমূলের কর্মীদের এভাবেই পঙ্গুত্বের দিকে ঠেলে দেয়, ধ্বংস করে একেকটি পরিবারের স্বপ্ন ।
শুধু বিএনপির রাজনীতি করার অপরাধে, কিশোরগঞ্জে পৌর বিএনপির সভাপতি আমিনুল ইসলাম আশফাককে না পেয়ে পুলিশ তার নিষ্পাপ যমজ দুই ছেলেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। সিরাজগঞ্জে ছাত্রদল নেতা হারুনর রশিদকে না পেয়ে পুলিশ তার অসুস্থ বাবাকে তুলে নিয়ে যায়। পঞ্চগড়ে জেলা যুবদলের সাধারণ সম্পাদক নুরুজ্জামান বাবুকে না পেয়ে পুলিশ তার পরিবারের সাথে অশালীন ও অসদাচরণ করে। নোয়াখালীর সুবর্ণচরে বিএনপির পক্ষে ভোট দেওয়ায় আওয়ামী লীগকর্মীদের হাতে গণধর্ষণের শিকার হন এক নারী। এগুলো বর্বরতার কয়েকটি উদাহরণ মাত্র, যা বিএনপির নেতা-কর্মী-সমর্থকদের ওপর বছরের পর বছর ধরে চলে আসা অগণিত নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরে।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে যুবদল সভাপতি মোহাম্মদ আলমগীরের বাড়িতে মুখোশধারীদের বোমা বিস্ফোরণ ও সশস্ত্র মহড়া, খুলনায় ফুলতলা বিএনপির আহ্বায়ক আবুল বাশারের বাড়িতে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের বোমা হামলা, কুমিল্লায় ১৯৬০ সাল থেকে ওয়ার্ড বিএনপি সভাপতি মজিবুর রহমান ফরহাদের মালিকানাধীন পারিবারিক দীঘির দখল নিয়ে আওয়ামী লীগের মৎস্যসম্পদ লোপাট, চাঁদপুরে ঢাকা উত্তর ওলামা দলের আহ্বায়ক জসিম উদ্দিনের পৈতৃক সম্পত্তি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আওয়ামী লীগের অবৈধ দখল – দেশ জুড়ে এমন লক্ষ-লক্ষ হামলা, দখল ও লুটতরাজের ঘটনা ঘটেছে। এভাবেই ফ্যাসিবাদের নিষ্পেষণে দীর্ঘ সময় ধরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দায় চুকেছে বিএনপির তৃণমূল।
বিএনপিকে নিশ্চিহ্ন করতে ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগের বিচারবহির্ভূত হত্যা, গায়েবি মামলা, ও নৃশংস নিপীড়ন দেশের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এর ফলস্বরূপ জাতিসংঘসহ স্বীকৃত মানবাধিকার সংস্থা ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে একের পর এক প্রতিবেদন প্রকাশিত হতে থাকে। যুক্তরাষ্ট্র র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা ও ভিসা নীতির মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে চাপ বাড়ায়।
তৃণমূলের স্পন্দন ও গণমানুষের নেতা তারেক রহমানের নেতৃত্বে, অবিরাম জুলুম-অবিচারের মাঝেও, বিএনপির নেতা-কর্মীরা মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের জন্য অবিচল সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকে। সেই অভীষ্ট লক্ষ্যে, রাজনৈতিক নেতৃত্বের অবদানে গড়ে ওঠা দীর্ঘদিনের ঐক্যকে ধারণ করে, গণতন্ত্রের পক্ষের সকল শক্তির বলিষ্ঠ ভূমিকায়, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থানে ফ্যাসিবাদের পতন ঘটে। বাংলাদেশের জনগণের এ বিজয় শুধুই দেশের মালিকানা ফিরে পাওয়ার বিষয় নয়। বরং এটি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার প্রতিশ্রুতি, যা অসীম ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত।
এ বিজয়ের পেছনে রয়েছে অসংখ্য নির্যাতিত মানুষের বেদনার অপ্রকাশিত ইতিহাস – গুম হওয়া ছেলের ফেরার প্রতীক্ষায় ব্যথাতুর মায়ের ডাক, স্বামী হারানো বেদনাবিধুর স্ত্রীর অনন্ত আর্তনাদ, পঙ্গু বাবার জন্য সন্তানের হৃদয়বিদারক হাহাকার, আর কারাগারে বন্দী ভাইয়ের জন্য বোনের নীরব প্রার্থনা। তাদের সকলের ১৬ বছরের রক্ত, শ্রম ও অশ্রু দিয়ে; প্রতিটি পরিবারের ক্ষোভ, ক্রোধ ও অব্যক্ত বিস্ফোরণ বুকে ধারণ করে; চলমান ছিল শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই। বস্তুত, ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ৪২২ জন, ২০২৩ সাল পর্যন্ত শহীদ ১,৫৫১ জন, গুম ৪২৩ জন (সকল রাজনৈতিক দল ও সাধারণ মানুষ মিলিয়ে প্রায় ৭০০ জন), আসামি ৬০ লক্ষ, এবং মামলা দেড় লক্ষ – এসব কেবল বিএনপির ত্যাগের পরিসংখ্যানই নয়। বরং বাংলাদেশের দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জনের পথে দলটির অবিচল সংগ্রাম ও অবদানের প্রতিফলন।
আমরা বিশ্বাস করি, যারা গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনে যুক্ত ছিল – গণতান্ত্রিক প্রতিটি ব্যক্তি, দল, সংগঠন ও গোষ্ঠী — তাদের সকলের আত্মত্যাগের যথাযথ স্বীকৃতি না দিলে তা হবে ইতিহাসের প্রতি অবিচার। সকল শ্রেণি-পেশা-মতের মানুষের অংশগ্রহণকে সম্মান জানিয়ে, জনগণের লুণ্ঠিত ভোটাধিকার ফিরিয়ে এনে একটি প্রকৃত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাই আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার। সেই পথযাত্রায় ও রাষ্ট্র সংস্কারে, বিএনপি ঘোষিত ৩১ দফা বাস্তবায়ন করে গড়ে তুলতে হবে একটি নিরাপদ ও মেধাভিত্তিক বাংলাদেশ, যেখানে প্রতিফলন ঘটবে জনগণের আকাঙ্ক্ষা ও প্রত্যাশার।