হরে কৃষ্ণ থেকে ‘উগ্রবাদী’: কীভাবে ইস্কন বাংলাদেশ সংকটের কেন্দ্রে পৌঁছালো

স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য, ভারতীয় গণমাধ্যম বুমলাইভ

অনুবাদকৃত:
চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ‘ব্রহ্মচারী’, যিনি একসময় আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইস্কন)-এর একজন সন্ন্যাসী ছিলেন, তিনি নিজেকে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক ও ধর্মীয় ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেন। জাতীয় পতাকার প্রতি অসম্মান প্রদর্শনের অভিযোগে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’ মামলায় গ্রেপ্তারের পর তার মুক্তির দাবিতে প্রতিবাদ শুরু হয়, যা দেশের নাজুক ধর্মীয় ভারসাম্যের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে।

পরিস্থিতি নাটকীয়ভাবে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ২৬ নভেম্বর, যখন দাসের মুক্তির দাবিতে বিক্ষোভ চলাকালে এক মুসলিম আইনজীবী এবং পাবলিক প্রসিকিউটর সাইফুল ইসলাম আলিফকে আদালতের বাইরে হত্যা করা হয়। এই ঘটনা এমন একটি সময়ে ঘটেছে যখন বাংলাদেশে মুসলিম মৌলবাদী শক্তির উত্থানের শঙ্কা বিদ্যমান এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দুদের প্রতিবাদ ক্রমেই উত্তেজনা বাড়াচ্ছে।


ইস্কন: উত্তেজনার পরিণতি ও বাংলাদেশে ধর্মীয় মেরুকরণের প্রেক্ষাপট

ইস্কনকে নিষিদ্ধ করার আবেদন নিয়ে ঢাকার হাইকোর্টে একটি পিটিশনের শুনানিতে বাংলাদেশের অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ আসাদুজ্জামান ইস্কনকে একটি ‘ধর্মীয় মৌলবাদী সংগঠন’ হিসেবে অভিহিত করেন এবং তাদের কার্যকলাপ তদন্তের বিষয়ে সরকারের মনোভাব তুলে ধরেন। আদালত সরকারের অবস্থান সন্তোষজনক মনে করে নিষেধাজ্ঞার সিদ্ধান্ত সরকারের হাতে ছেড়ে দেয়।

এই উত্তেজনা বৃদ্ধিতে ভুল তথ্যও বড় ভূমিকা পালন করে। কিছু গণমাধ্যম, যেমন রয়টার্স, ভুলভাবে জানায় যে নিহত আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হিন্দু সন্ন্যাসীর আইনজীবী ছিলেন। পরে বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব সাইফুল আলম এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেন এবং ভারতীয় মিডিয়ার ওপর ভুল তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ তোলেন।

আইনজীবী আলিফের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্রোফাইল থেকে জানা যায়, তিনি আগস্টের গণজাগরণ আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন এবং ইস্কনের ভূমিকাকে পরিস্থিতি উত্তেজিত করার জন্য দায়ী করেছেন। এরই মধ্যে বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষ ইস্কনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ১৭ জনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছে। ইস্কনকে নিষিদ্ধ করার দাবিতে বেশ কিছু সমাবেশ চলার সময় ইস্কনের একটি মন্দিরে হামলা হয়। এই ঘটনায় সম্প্রতি নিষিদ্ধ হওয়া ছাত্রলীগের তিনজন সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।

ইস্কনের ভাবমূর্তির বিবর্তন
গ্লোবাল হিন্দু সংগঠন হিসেবে পরিচিত ইস্কন, যা শান্তিপূর্ণ ধর্মীয় আন্দোলন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত, এখন বাংলাদেশে কথিত মৌলবাদী সংগঠনের আকারে রূপান্তরিত হয়েছে।

চিন্ময় কৃষ্ণ দাস: কে এই সন্ন্যাসী?
ইস্কন থেকে জুলাই ২০২৪-এ বহিষ্কৃত চিন্ময় কৃষ্ণ দাস আগস্টের আন্দোলনের পরে হিন্দু প্রতিবাদের মুখ হয়ে ওঠেন। তিনি বিভিন্ন মন্দিরে হামলার প্রতিবাদ করেন এবং ভারতীয় মিডিয়ায় বক্তব্য দেন। তবে নভেম্বরের শুরুতে ইস্কন প্রকাশ্যে ঘোষণা দেয় যে তিনি এবং তার দুই সহযোগী সংগঠন থেকে বহিষ্কৃত।

পরিস্থিতির উত্তপ্ততা বৃদ্ধি
২৬ নভেম্বর, আইনজীবী আলিফ হত্যার একদিন পরে, ঢাকাভিত্তিক সংবাদমাধ্যম “বাংলা আউটলুক” একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ইস্কন ২০২৩ সালের অক্টোবরে চিন্ময় দাসকে শিশু নির্যাতনের অভিযোগে প্রথমে সাময়িক বরখাস্ত করে এবং পরে তদন্তে অসহযোগিতা করায় তাকে বহিষ্কার করা হয়।

তবে চিন্ময় দাস বর্তমানে বাংলাদেশের সনাতনী সম্প্রদায়ের নতুন সংগঠন “সন্নিলিত সনাতনী জাগরণ জোট”-এর মুখপাত্র হিসেবে কাজ করছেন এবং হিন্দু প্রতিবাদের প্রধান মুখ হিসেবে পরিচিত।

বাংলাদেশে ইস্কন: বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু
২০২১ সাল থেকে বাংলাদেশে ইস্কন মৌলবাদী শক্তির টার্গেটে পরিণত হয়েছে। ২০২১ সালের দুর্গাপূজার সময় হামলার পর ইস্কন আন্তর্জাতিক মহলে বিষয়টি তুলে ধরে। এর ফলে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের নিরাপত্তা নিয়ে নতুন বিতর্ক শুরু হয়।

ধর্মীয় মেরুকরণ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা
বর্তমানে বাংলাদেশে মুসলিম ও হিন্দু উভয়ের মধ্যেই ডানপন্থী প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। ইস্কনকে কেন্দ্র করে উত্তেজনা ধর্মীয় মেরুকরণ এবং রাজনৈতিক অস্থিরতাকে আরও বাড়িয়ে তুলছে।

এই পরিস্থিতি শুধু ইস্কনের ভবিষ্যৎ নয়, বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার এবং নিরাপত্তা নিয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন তুলেছে।

More From Author

ইসকন ও ভারতীয় আধিপত্য মোকাবেলার জন্য প্রয়োজন হল একটি শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি

ভারতীয় পণ্য বর্জনের ‘ডাক’ রিজভীর

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *