বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়কে রাজনীতিকরণ

অনুবাদ:

দ্য ডিপ্লোম্যাট

বাংলাদেশের সামাজিক কাঠামোতে ধর্মীয় সম্প্রীতির ঐতিহ্য বিদ্যমান থাকলেও, সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা মাঝে মাঝেই দেখা দেয়, যা রাজনীতি এবং জনমতের ওপর প্রভাব ফেলে। এসব উত্তেজনা প্রায়শই রাজনৈতিক এজেন্ডার দ্বারা প্রভাবিত হয়। বাংলাদেশের হিন্দুদের মুখোমুখি হওয়া চ্যালেঞ্জগুলো সমাধানের পরিবর্তে, রাজনৈতিক দলগুলো, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ (আ.লীগ), সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংগ্রামকে রাজনীতিকরণ করার ইতিহাস বহন করে।

৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর, আ.লীগ পুনরায় সাম্প্রদায়িক বিষয়গুলোকে রাজনীতিকরণের কৌশল হিসেবে ব্যবহার শুরু করে, যা বাংলাদেশে হিন্দু ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস বাড়িয়ে তুলেছে। আ.লীগ ক্রমবর্ধমানভাবে হিন্দু সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে, যেখানে ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক পরিচয়ের সীমারেখা মুছে গেছে। এর ফলে হিন্দুদের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ঝুঁকি তৈরি হয়েছে।

হাসিনার ভারত গমনের পর, বাংলাদেশে আ.লীগের সদস্যরা ছাত্রদের দমন করার উদ্দেশ্যে নির্যাতনের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগে প্রতিক্রিয়ার সম্মুখীন হন। এতে হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের আ.লীগ নেতারা সমালোচনার শিকার হন এবং এমনকি হামলার মুখে পড়েন; এই সংঘাত শুধু সাম্প্রদায়িক ছিল না, বরং রাজনৈতিকও ছিল। ৫ আগস্ট থেকে ২০ আগস্টের মধ্যে, সংখ্যালঘুদের ১,০৬৮টি বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়, যার মধ্যে কমপক্ষে ৫০৬ জনের মালিক আ.লীগের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল বলে প্রথম আলো জানিয়েছে।

বাংলাদেশের হিন্দু জনগোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় প্রতিষ্ঠিত দলগুলোও রাজনীতিকরণ হয়েছে। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের নেতারা ব্যক্তিগত আর্থসামাজিক সুবিধার জন্য আ.লীগের এজেন্ডা প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন, যা বৃহত্তর সম্প্রদায়ের স্বার্থকে উপেক্ষা করছে। সামাজিক মাধ্যমে ঐক্য পরিষদের কিছু নেতার বিরুদ্ধে হাসিনা সরকারের সুবিধাভোগী হওয়ার অভিযোগ উঠেছে, যা সংগঠনটির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।

হাসিনার পতনের দিকে অগ্রসর হওয়া বিক্ষোভের সময়, বিক্ষোভকারীরা বিদ্রুপ করে স্লোগান দিয়েছিল, “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার!” এর মাধ্যমে হাসিনার সেই অভিযোগের জবাব দেওয়া হয়েছিল যে, বিক্ষোভকারীরা “রাজাকারের” বংশধর। ঐক্য পরিষদ তখন বিক্ষোভকারীদের শাস্তি দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আ.লীগের বক্তব্য প্রতিধ্বনিত করে এবং বিক্ষোভকারীদের আরও বিচ্ছিন্ন করে। সম্প্রতি, ঐক্য পরিষদ দাবি করেছিল যে, হাসিনার পরবর্তী প্রশাসনের আমলে নয়জন হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু নেত্র নিউজ এর তদন্তে এই দাবি মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এর ফলে সংগঠনটির বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এদিকে, ভারতের হিন্দুত্ববাদী বিজেপি এবং কিছু মিডিয়া বাংলাদেশের সংখ্যালঘু ইস্যু নিয়ে তাদের নিজস্ব এজেন্ডা প্রচার করছে। আল জাজিরা (৮ আগস্ট), আনাদোলু এজান্সি (১০ আগস্ট), বিবিসি (১৮ আগস্ট) এবং প্রথম আলো (২৯ আগস্ট)-এর রিপোর্ট অনুযায়ী, ভারতীয় মিডিয়া বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার ব্যাপারে ভুয়া তথ্য ছড়িয়েছে।

২০২১ সালে, হাসিনার শাসনামলে, যখন বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে এবং ২৭টি জেলায় ১১৭টি হিন্দু মন্দিরে হামলা হয়, তখন ভারত নীরব ছিল। কিন্তু ২০২৪ সালে, যখন বাংলাদেশে ৩১,৪৬১টি পূজা মণ্ডপে শান্তিপূর্ণভাবে দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়, তখনও ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছোটখাটো ইস্যু নিয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে দোষারোপ করে। এসব ঘটনাপ্রবাহ ভারতের পক্ষপাতদুষ্ট আচরণকে নির্দেশ করে।

শেখ হাসিনার শাসনামলে হিন্দু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তার কথা বলা হলেও তা একপ্রকার ভ্রান্ত ধারণা। হাসিনা মূলত হিন্দু ভোট আকৃষ্ট করতে চেষ্টা করেছেন আ.লীগের ধর্মনিরপেক্ষ অবস্থান এবং ভারতের সাথে মিত্রতার কারণ দেখিয়ে। কিন্তু এই কৌশল সত্ত্বেও, আ.লীগ হিন্দু এবং অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সহিংসতা ও সাম্প্রদায়িক আক্রমণ থেকে কার্যকরভাবে রক্ষা করতে পারেনি।

সংক্ষেপে:
বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে প্রকৃত আস্থা প্রতিষ্ঠার ওপর, যেখানে হিন্দু সম্প্রদায়কে রাজনৈতিক হাতিয়ার নয় বরং বহুমাত্রিক সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে গণ্য করা হবে।

More From Author

হাসনাত-সার্জিসকে ট্রাকচাপা দিয়ে ‘হত্যাচেষ্টা’

তারেক রহমানের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির চার মামলা হাইকোর্টে বাতিল

তারেক রহমানের আহ্বান শক্ত হাতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *