একজন সাহসী তরুণের কথা 

কে এম বশীর,শহীদ জেহাদের বড় ভাই

শহীদ আসাদের ক্লাস ছুঁয়ে ৬৯ এর গন অভ্যুত্থান। সারাদেশে চলছিল আন্দোলনের বাঁধভাঙ্গা জোয়ার। সেদিন ছিল ৬ সেপ্টেম্বর। প্রচন্ড প্রতিবাদী চিৎকারে উল্লাপাড়ার নবগ্রামে যে শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়েছিল, সে ছিল জেহাদ। ফুটফুটে শিশুটি বাড়তে থাকলো দারিদ্রতার নিষ্পেষণে। স্কুল জীবন থেকেই তার চোখ ছিল বিভিন্ন পত্রপত্রিকা পড়ার। জানার এত আগ্রহ গ্রামাঞ্চলে খুব কমই দেখা যেত। বাল্যকাল থেকেই সে ছিল ভিষন প্রতিবাদী। কোথাও কোন অন্যায় দেখলেই সে রুখে দাঁড়াতো, প্রতিবাদ করত। অথচ আচরণে সে ছিল অত্যন্ত বিনয়ী। সারাক্ষণ তার মুখে লেগে থাকতো অনাবিল হাসির ছোঁয়া। এস এস সি পাশ করলো ১৯৮৬ সালে। শুরু হলো তার অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। উল্লাপাড়ার রাজনৈতিক অঙ্গনে আওয়ামী লীগ এবং জাসদের প্রবল দাপটে অন্যান্য সংগঠন হয়ে থাকত কোন ঠাসা। ছাত্রদল ছিল তেমনি একটি অবস্থায়। শহীদ জিয়ার আদর্শ ও ১৯ দফা কর্মসূচি এবং বেগম জিয়ার নেতৃত্বে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৮৭ সনে সে ছাত্রদলের যোগ দিয়ে ছাত্র রাজনীতির অঙ্গনে প্রবেশ করল। ১৯৮৭ বিএনপির প্রতিটি কর্মসূচিতে যোগ দিতে সে ঢাকায় গিয়েছে। ১৯৮৮ সনের প্রলয়নকারী বন্যায় নিজের বাড়ি তলিয়ে গেলেও কখনো তাকে ঘরে পাওয়া যায়নি, প্রাণ দলের সাথে সারা থানায় ক্লান্তিহীন সহযোগিতা করেছে এবং মায়ের কাছে মানুষের অপরিসীম দুর্দশার কথা বর্ণনা করে, নিজেদের দুর্দশার সান্ত্বনা নিয়েছে। ১৯৮৯ সনে কলেজ নির্বাচন এবং উপজেলা নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে সে নিজেকে এত বেশি পরিচিত করে নিয়েছিল যে পল্লীবাসীরা জেহাদকে ব্যক্তিগতভাবে চিনতো। 

”আমার কিবা ক্ষমতা আছে, আছে তো শুধু প্রাণটা, এটাও আমি হাসতে হাসতে দিতে পারতাম যদি, নিশ্চিত হতাম আমার প্রানের বিনিময়ে আপনাদের দুঃখ যাবে, আপনারা দু-মুঠো খাবার পাবেন”-জেহাদ

সে অন্যের কষ্টকে নিজের মধ্যে ভীষণ গভীরভাবে গ্রহণ করত। একদিন এক ভিকারী নিয়ে এসে খাবার চাইলেন জেহাদ মাত্র কলেজ থেকে এসে, গোসল করে খাবে। ভিখারিনীর ডাকে বেরিয়ে এলো জেহাদ, ঘাড়ে গামছা, আবারও ঢুকে গেল ঘরে মাকে বলল খাবার আছে? মা বললেন তোর খাবারটাই শুধু আছে. খাবারটা নিয়ে সেই ভিখারিণীকে দিতেই ভিখারিনী অশ্রু স্বজল কন্ঠে বললেন, বাবা, এই গ্রামে তো অনেক বড় বড় বাড়ি ঘুরলাম, কেউ এক মুঠো খাবারও দিল না, আমি দুইদিন কিছুই খাইনি। সেদিন জেহাদকে বলতে শুনেছিলাম”আমার কিবা ক্ষমতা আছে, আছে তো শুধু প্রাণটা, এটাও আমি হাসতে হাসতে দিতে পারতাম যদি, নিশ্চিত হতাম আমার প্রানের বিনিময়ে আপনাদের দুঃখ যাবে, আপনারা দু-মুঠো খাবার পাবেন”

আরেক দিনের কথা মনে পড়ে, মাকে বলেছিল”মা আমাদের এ জাতির দুর্ভোগ কবে যাবে, যদি এমন হতো কোন একজনের জীবনের বিনিময়ে আমাদের জাতির অভিশাপ দূর হতো, তাহলে আমি নিজেকে উৎসর্গ করতাম”

আরেকদিন আমার এক গ্রাম্য বড় ভাই এর সাথে রাজনৈতিক আলাপ হচ্ছিল জেহাদের। পাশে আমিও ছিলাম, ওই ভাইটি যখন বিভিন্ন যুক্তিতে বেড়ে উঠছিল না, তখন নেতৃ সম্পর্কে আপত্তিকর উক্তি করায় জেহাদ বলেছিল”আমার মা এবং আমার নেত্রীর ব্যাপারে কোন অশোভন কথা বলে আমাকে বেয়াদব করে তুলবেন না। আপনারা বড়, কিন্তু দৃষ্টিভঙ্গি খুবই খারাপ ‌”।

সাংসারিক দুরবস্থার কথা তুললেই সে তার স্বভাবসুলভ অনাবিল হাসিতে পরিবেশের ঘনীভূত মেঘকে ভাসিয়ে দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলতো “এইতো আর কটা দিন, আমি সমস্ত দায়িত্ব পালন করব”

জিহাদের সেদিনের বলার গভীরতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। যার অপরের প্রতি সম্মান বোধ কম সে নিজের সম্মান সম্পর্কেও সচেতন হতে পারে না এই শিক্ষা আমরা বাবার কাছ থেকে পেয়েছি। কলেজ নির্বাচনে ছাত্রদলের পরাজয় ওকে যেন আরও শতগুণ বেশি সাংগঠনিক দিক থেকে সক্রিয় করে তুলল। সকাল সন্ধ্যা একাকার হয়ে গেল সাংগঠনিক কর্মকান্ডে। মা প্রায়ই রাগ করতেন, আমি বাড়ি গেলেই মায়ের নালিশ, পড়াশুনা বাদ দিয়ে সারাদিন করে কি জিজ্ঞেস করিস? প্রায়ই মাকে বোঝাতাম, এখন তো সে আর আপনার ছোট্ট জেহাদ নেই, সে এখন ডিগ্রীর ছাত্র, ওর স্বাধীনতায় হাত দিতে গেলে ফলাফল বিপরীত হতে পারে। সাংসার িক এবং পারিপার্শ্বিক প্রতিকূলতার মধ্যেও সে তার সাংগঠনিক তৎপরতা একটুও ক্ষুন্ন হতে দেয়নি। সাংসারিক দুরবস্থার কথা তুললেই সে তার স্বভাবসুলভ অনাবিল হাসিতে পরিবেশের ঘনীভূত মেঘ কে ভাসিয়ে দিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলতো “এইতো আর কটা দিন, আমি সমস্ত দায়িত্ব পালন করব”

জেহাদ ছিল প্রচন্ড রকমের সাংস্কৃতিক মনা। সে নিজে খুবই ভালো গান গাইতে পারতো। সে ভালো ক্রিকেট খেলত, ফুটবল প্রিয় ছিল জেহাদের। কোন রাজনৈতিক অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলেই তা করতো জেহাদের, উপস্থাপনা করতে হবে। উপস্থাপনায় সে উল্লাপাড়া থানায় শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করেছিল।

অনেককে বলতে শুনেছি, সারা সিরাজগঞ্জ জেলায় সে একজন ভালো উপস্থাপক। উল্লাপাড়া উপজেলায় ফুটবল খেলা রিলে করতে তার চুরি ছিল না। অপূর্ব শব্দ চয়ন এবং বাচনভঙ্গি ছিল জিহাদের। 

হঠাৎ করেই ওর মুখটা মলিন হয়ে উঠলো। পরক্ষণেই তা সামলে নিয়ে সেই চিরাচরিত হাসিতে বাকি জড়িয়ে ধরে বলল, “মা, এতগুলো কাজ শেষ করে, আকতো ফিরতে পারবো না”। আপনি আমায় মাফ করে দেবেন এবং দোয়া করবেন।

এভাবেই একদিন সাংগঠনিক ডাক এল, সচিবালয় অবরোধ কর্মসূচিকে সফল করতে হবে। সেদিন ছিল 9 অক্টোবর ৯০। সকালে বের হল ঢাকায় অবরোধকর্মসূচিতে যোগ দেবার প্রস্তুতি পর্ব তৈরি করতে। দুপুরের পর ৩/৪ চারটায় বাড়ি এলো খেতে। এই বের হয়ে আসছিল, মা ডেকে বলল কিরে জিহাদ? সন্ধ্যায় খেতে আসবি তো? হঠাৎ করেই ওর মুখটা মলিন হয়ে উঠলো। পরক্ষণেই তা সামলে নিয়ে সেই চিরাচরিত হাসিতে বাকি জড়িয়ে ধরে বলল, “মা, এতগুলো কাজ শেষ করে, আকতো ফিরতে পারবো না”। আপনি আমায় মাফ করে দেবেন এবং দোয়া করবেন। ৯ অক্টোবর ৯০ ঠিক যাত্রার প্রাক্কালে স্থানীয় বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়ে প্রাসঙ্গিক কথার প্রেক্ষিতে হাসতে হাসতেই বলে ফেলেছিল”দেখ, আমার নাম জেহাদ, জেহাদ ঘোষনা করতেই যাচ্ছি, যদি আমি শহীদ হই, তোরা আমাকে আমার প্রিয় নেতা শহীদ জিয়ার মাজারের পাশে রেখে আসিস”।

”তোমরা সবাই গোসল করে পবিত্র হয়ে নাও, তারপর আমরা নামাজ পড়ে নাস্তা করে অবরোধে যাব”-জেহাদ

বাস ছাড়লো ৬৫ জনের দল নিয়ে। দলনেতা ছিলেন বি এন পির উল্লাপাড়ার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট জনাব মতিয়ার রহমান। সবার ছোট ভাই শহীদও ছিল সে বাসেই। এক সময় জেহাদ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল”তোমরা সবার নাম ঠিকানা লিখে পকেটে রেখো, যাচ্ছি অবরোধে, কে কোথায় থাকি বলা তো যায় না”। এক সময় সে সব বন্ধুদের নাম-ঠিকানা নিজের ডায়েরির পাতা ছিড়ে লিখে সবার পকেটে দিয়ে দিল। ভাস্তি সকালে বিএনপি’র কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এসে দাঁড়ালে জেহাদ সবাইকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল”তোমরা সবাই গোসল করে পবিত্র হয়ে নাও, তারপর আমরা নামাজ পড়ে নাস্তা করে অবরোধে যাব”। আরো বলেছিল তোমরা সবাই ফিরে গেলেও আমি কিন্তু ফিরব না, কারণ আমাকে বড় ভাইয়ের বাসায় যেতে হবে। স্বৈরাচারের বুলেট তার উজ্জ্বল তাজা প্রাণটাকে আর তার বড় ভাইয়ের বাসা পর্যন্ত পৌঁছাতে দেয়নি। সব কাজ তার করা হয়ে গেছে, কিন্তু বিজয়ের কলরব নিয়ে ফিরে গিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে বলতে পারেনি”মাগো তোমার বীর সন্তানকে দেখো, সে স্বৈরাচারের পতন নিশ্চিত করে এসেছে”। ফিরেছিল জেহাদ, লাশ হয়ে এবং হাজারো তরুণের প্রতিশ্রুতি নিয়ে”স্বৈরাচারের পতন না হওয়া পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরে যাব না”, ফিরেছিল একটি মাত্র স্লোগান কে তার তরুণ বুকের তাজা রক্তে অবরোধকে বেগবান করে দিয়ে,”সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্য জিন্দাবাদ, জিন্দাবাদ।”খুন হয়েছে আমার ভাই, খুনি এরশাদ রক্ষা নাই।”পেরেছিল তার লাশ তরুণদের প্রতিজ্ঞা নিয়ে। রাজনৈতিক দলগুলো যদি এরপরও এক মঞ্চে না আসে, আমরাই স্বৈরাচার এরশাদকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করব”। ফিরে এসেছিল জিহাদ একটি নির্বাক, নিঃস্পন্দ, নিষ্পাপ লাশ হয়ে, যাকে ঘিরে আমাদের পরিবারের ছিল একটি সুন্দর স্বপ্ন। যাকে জানিয়ে দিতে পারিনি”জেহাদ, তুমি শুধু আমাদের নও, তুমি সারা জাতির গৌরব”। সে চেনে যেতে পারলো না তার পরম শ্রদ্ধাভাজন নেত্রী জীবনে তার কাছে পৌঁছাতে না পারলেও মরণে তিনি প্রথম এসেছিলেন তাকে বিরমাল্য পরাতে।

“হে বীর, এ অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী আত্মা, ঐক্যের প্রতীক, এই সুন্দরের প্রতিশ্রুতি, তুমি আর একটিবার জেগে ওঠো আমাদের মাঝে। যেন আমরা জাতির প্রয়োজনে তোমারই মত বীরের মৃত্যুবরণ করতে পারি”

More From Author

অক্টোবর শহীদ জেহাদ পরিবারের জন্য বেদনার মাস

“শহীদ জেহাদ দিবস” ২০২৪,উপলক্ষে বি এন পি’র এক্টিং চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বিবৃতি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *