মাহির তাজওয়ার
লেখক, গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ভারতীয় মদদপুস্ট হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ইসকনের অন্যতম সংগঠক চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের অনুসারীদের হাতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের সরকারি কৌঁসুলি সাইফুল ইসলাম আলিফের নির্মম হত্যাকান্ড প্রমাণ করেছে যে স্বৈরাচার হাসিনার পতন হলেও এদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদ এখনো বলবৎ আছে । ১৯৬৬ সালে নিউইয়র্কে প্রতিষ্ঠিত হওয়া আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ বা ইসকন (ISKCON) ‘ধর্মীয় উদ্দেশ্য নিয়ে জনসেবা, শিক্ষা, ধর্মচর্চা এবং অধ্যাত্মিক চর্চা’ করে দাবি করলেও অনেক হিন্দু ও হিন্দু নেতাদের মতে এটি একটি হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক সংগঠন। এই সংগঠনটি ভারতের আরএসএস ও তাদের রাজনৈতিক বাহু বিজেপির একটি সহযোগী সংগঠন যারা ভারতের বর্তমান সীমানা ছাড়িয়ে আশেপাশের ভূখণ্ডগুলোকে যেমনঃ বাংলাদেশে, বার্মা, পাকিস্তানকে একত্র করে একটি অখন্ড ভারত ও ভারতীয় আধপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক দর্শন বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত। হিন্দুত্ববাদীদের অখন্ড ভারত(Greater India) মূলত মুসোলিনির ফ্যাসিবাদ এবং প্যালেস্টাইনে জায়নবাদী “Eretz Israel”/Greater Israel” প্রকল্প দ্বারা অনুপ্রাণিত একটি উপনিবেশবাদী প্রকল্প। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে ভারতের আঞ্চলিক আধিপত্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে চীনকে নিয়ন্ত্রণ এবং হিন্দু রাষ্ট্রের অপ্রতিদ্বন্দ্বী অন্য কোন শক্তি ও ইসলামের উত্থান রোধ করতে এই প্রকল্প হাতে নিয়েছিল। হিন্দুত্ববাদীরা বিশ্বাস করে যে তাদের অস্তিত্বের মূল হচ্ছে ইসলাম ও মুসলিমদের বিরুদ্ধে প্রচন্ড ঘৃণা। তাই হিন্দুত্ববাদী ও ভারত সরকারে তাদের সহযোগীরা প্রতিনিয়ত ভারতে মুসলিমদের বিরুদ্ধে সহিংসতাকে উস্কে দেয়া, পিটিয়ে হত্যা ,গণহত্যা, মসজিদ ধ্বংস করা, মুসলিম নারীদের হিজাবকে অপমাণ করা, মুসলিম নারীদেরকে ধর্ষণ ও অপহরণ, গরু জবাই অপরাধ হিসেবে গণ্য করা সহ ব্যাপক ইসলামবিদ্বেষ ও ইসলামফোবিয়ার পরিবেশ সৃষ্টি করে চলেছে। হিন্দুত্ববাদীদের মতে মুসলিমদের যাওয়ার জন্য মাত্র দুটি জায়গা আছে: “হয় পাকিস্তান নয় কবরস্থান”। এই মূলনীতিকে ব্যবহার করে ভারতের হিন্দুত্ববাদীরা তাদের ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষ বজায় রেখেছে। আর ভারত ইসকনের মত উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনকে তাদের প্রক্সি হিসেবে ব্যবহার করে এই ফ্যাসিবাদ ও ইসলামবিদ্বেষকে বাংলাদেশে রপ্তানি করেছে যার নির্মম শিকারে পরিণত হলেন চট্টগ্রামের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ।
কার্যত, এদেশে ইসকনের মত উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের বিস্তার ঘটেছিল ভারতের প্রতি পতিত স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের নতজানু পররাষ্ট্রনীতির কারণেই। হাসিনা সরকার ভারতের চক্রান্তে পিলখানায় ৫৭ জন মেধাবী সেনা কর্মকর্তা হত্যাসহ দেশের অর্থনীতি, কৌশলগত সম্পদ এবং অবকাঠামো মুশরিক শত্রুদের হাতে তুলে দিয়ে উপর ভারতীয় আধিপত্যবাদ প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দেয়ার মাধ্যমে নিজেদের সিংহাসনকে সুরক্ষিত করেছিল। এদেশে ভারতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন ও ভারতীয় ও স্বার্থ রক্ষায় ক্ষেত্রে হাসিনা ছিল নিবেদিতপ্রাণ। কিন্তু ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাসিনার পতন ছিল এদেশে ভারতীয় আধিপত্যবাদের প্রতি বিশাল একটা চ্যালেঞ্জ। একই সঙ্গে হাসিনা পতনের সাথে সাথে এদেশে সক্রিয় ভারতের দালালদের অবস্থানও বেশ নড়বড়ে হয়ে পড়ে। হাসিনার পতন সত্ত্বেও ভারত সংখ্যালঘু ইস্যুকে ব্যবহার করে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য আমাদের দেশের বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে এবং পাল্টা আঘাত করার জন্য সঠিক সময়ের অপেক্ষা করছে। অন্যদিকে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম স্পিরিট যেহেতু ছিল বিদেশী আগ্রাসন মুক্ত একটা সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা, তাই দেশের জনগণের মধ্যে ভারত বিরোধী মনোভাব সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌছেছে এবং ক্রমেই তা বিস্ফোরিত হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে এদেশে ভারতের আধিপত্য হুমকির মুখে পড়ায় ভারত তার আধিপত্য রক্ষার শেষ প্রক্সি হিসেবে হিন্দুত্ববাদী সংগঠন ইসকনকে ভারতবিরোধী ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে লেলিয়ে দিয়েছে। অথচ পরিতাপের বিষয় হচ্ছে অন্তর্বতী সরকারও পতিত হাসিনা সরকারের মতই ভারতের ব্যাপারে তাদের নতজানু নীতি অব্যাহত রেখেছে। সরকার এদেশে ভারতের আধিপত্য রক্ষার শেষ হাতিয়ার ইসকনের মত উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করাসহ ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিচ্ছে না। বিভিন্ন ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলোও ইসকন এবং ভারতীয় আগ্রাসনের বিষয়ে জনগণকে ধৈর্য্য ও সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়ে তাদের ভারত-পন্থী মনোভাব বজায় রেখেছে।
একটি নতজানু পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে ভারতীয় আধিপত্য ও তাদের আগ্রাসন মোকাবেলা করা সম্ভব নয়। এ জন্য শক্তিশালী একটি পররাষ্ট্রনীতি প্রয়োজন। ছাত্র-জনতার মধ্যে থেকে ভারতকে শত্রুরাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করার যে দাবি উঠছে সে বিষয়টি বিবেচনার দাবি রাখে। কারণ ছাত্র-জনতা এদেশে ভারতের আধিপত্য দেখতে চায় না। ইসকনের মত উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলো যেহেতু উস্কানিমূলক কর্মকান্ড এবং বক্তব্য দিয়ে বিভিন্ন সহিংসতায় লিপ্ত হচ্ছে, তাই ইসকন নিষিদ্ধের পাশাপাশি ভারতের বিভিন্ন গুপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর কার্যক্রম মনিটরিং এবং এগুলোকে বন্ধ ঘোষণা করা উচিত বলে আমি মনে করি। অন্তর্বর্তী সরকারকে ভারতের সাথে কৃত সন্ধি ও চুক্তিসমূহও খতিয়ে দেখতে হবে যাতে আমাদের উপর ভারতের কোন কৌশলগত সুবিধা নিশ্চিত না হয়। অনতিবিলম্বে পিলখানা হত্যাকান্ডের বিচারসহ এদেশে চিন্হিত ভারতের দালালদেরকে বিচারের আওতায় আনতে হবে যাতে এদেশে ভারতীয় ষড়যন্ত্রের পথ রুদ্ধ করে দেয়া যায়। কিন্তু এগুলোর কোনটিই একটি শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি ছাড়া বাস্তবায়ন করা সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে ইসলামী খিলাফত সরকারের পররাষ্ট্রনীতির মাধ্যমে এগুলো সহজে বাস্তবায়নযোগ্য বলে ইঙ্গিত করেছেন ইসকনের বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক বিক্ষোভে অংশ নেয়া অনেকেই।