
নিজস্ব প্রতিবেদক
অন্তর্বর্তী সরকারের ওপর সংস্কার বাস্তবায়নের ব্যাপক চাপ থাকলেও বাস্তবে সেই প্রক্রিয়া থমকে আছে। দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকার বেশ কয়েকটি কমিশন ও টাস্কফোর্স গঠন করলেও তাদের সুপারিশ বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না। এ নিয়ে অর্থনীতিবিদ ও বিশিষ্টজনদের মধ্যে গভীর সংশয় সৃষ্টি হয়েছে।
গতকাল রাজধানীর ব্র্যাক ইনে অনুষ্ঠিত দুই দিনের সম্মেলনের শেষ দিনে অর্থনীতিবিদ ও গবেষকদের আলোচনায় এসব বিষয় উঠে আসে। ‘অর্থনীতির পুনঃকৌশলকরণে টাস্কফোর্সের সুপারিশ’ শীর্ষক সম্মেলনের সমাপনী অধিবেশনে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, “সরকারের দায়িত্ব নেওয়ার সাত মাস পর এখন প্রশ্ন উঠছে— সংস্কারের সুপারিশগুলোর কোনটি বাস্তবায়ন হয়েছে?”
সংস্কারের গণআকাঙ্ক্ষা ও বাস্তবতা
অধ্যাপক রেহমান সোবহান আরও বলেন, শুধু অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থাই নয়, রাষ্ট্রীয় সকল ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রেও জনগণের মধ্যে বড় ধরনের সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব ছিল এসব সংস্কার বাস্তবায়ন করা। এখন পর্যন্ত কিছু সংস্কারকাজ সম্পন্ন হওয়া উচিত ছিল, যাতে নির্বাচিত সরকার ক্ষমতা গ্রহণের সময় অসমাপ্ত সংস্কারগুলোর বিষয়ে সুস্পষ্ট ধারণা পেত।
তিনি আরও বলেন, নির্বাচিত ও অন্তর্বর্তী সরকারের বাস্তবতা ভিন্ন। তাই নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সংস্কার সম্পন্ন করতে সংলাপ ও অ্যাডভোকেসি চালিয়ে যেতে হবে। প্রয়োজনে নতুন কমিশন গঠনেরও পরামর্শ দেন তিনি।
টাস্কফোর্সের সুপারিশ উপেক্ষিত
অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণ ও টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে সরকার গত ১১ সেপ্টেম্বর ১২ সদস্যের একটি টাস্কফোর্স গঠন করে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুর্শিদ এই টাস্কফোর্সের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
তবে, অধিবেশনে তিনি হতাশা প্রকাশ করে বলেন, “আমরা প্রায় ৫০০ পাতার প্রতিবেদন জমা দিয়েছি। অথচ উপদেষ্টাদের সময় হয়নি তা পড়ার। কেউ কেউ বলেছেন, আমাদের তা পড়ে বুঝিয়ে দিতে হবে। তাহলে এত বড় পরিসরে টাস্কফোর্স গঠনের প্রয়োজন কী ছিল?”
দখলবাজি ও দুর্নীতি
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, রাজনৈতিক সংস্কারের অভাবে দখলবাজি ও চাঁদাবাজির প্রবণতা আরও বেড়েছে। তিনি অভিযোগ করেন, ৫ আগস্টের পর থেকে এ ধরনের কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, কেবল ব্যানার পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু দুর্নীতির ধরন অপরিবর্তিত রয়ে গেছে।
ড. ইফতেখারুজ্জামান আরও বলেন, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত কার্যক্রম স্থগিত রাখতে ফোন পাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ সংস্কার ছাড়া এ পরিস্থিতির উন্নতি সম্ভব নয়। মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ও বৈষম্যবিরোধী চেতনা ধারণ করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকেই নিজেদের সংস্কার প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে হবে।
শিক্ষা খাতে সংকট
সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানুল্লাহ বলেন, “আপনি যখন প্রাথমিক শিক্ষকদের তৃতীয় শ্রেণির মর্যাদা দেন, তখন কিভাবে তারা প্রথম শ্রেণির নাগরিক তৈরি করবেন?” তিনি বলেন, এমপিওভুক্ত না করেও শিক্ষকদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, যা একটি ত্রুটিপূর্ণ ব্যবস্থা।
তিনি আরও বলেন, “জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা শিক্ষা দিচ্ছি, কিন্তু মান নিশ্চিত করতে পারছি না। কারণ পর্যাপ্ত মনিটরিং নেই, প্রশিক্ষিত শিক্ষক নেই। ৮ থেকে ১০ হাজার টাকা বেতনে অনার্সের শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে, যা শিক্ষার গুণগত মানের জন্য হুমকি।”
সংস্কারের ভবিষ্যৎ
সিপিডির সম্মাননীয় ফেলো অধ্যাপক রওনক জাহান বলেন, অতীতেও বহু সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সংস্কার উদ্যোগও থেমে যায়। তিনি সংস্কার বাস্তবায়নের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীসহ বিশিষ্টজনেরা আলোচনায় অংশ নেন এবং সরকারের সংস্কার উদ্যোগে গতি আনতে কার্যকর পদক্ষেপের ওপর গুরুত্বারোপ করেন।