মাহির তাজওয়ার
লেখক, গবেষক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক
গত ২৪ অক্টোবর নিউইয়র্ক টাইমস আফগানিস্তানের বর্তমান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সিরাজুদ্দিন হাক্কানী কে নিয়ে “আফগানিস্তানের মোস্ট-ওয়ান্টেড জঙ্গি এখন কি পরিবর্তনের সেরা আশা?” এই শিরোনামে একটি সাক্ষাৎকারের উপর ভিত্তি করে নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। প্রায় দুই দশক ধরে হাক্কানি নেটওয়ার্কের বর্তমান প্রধান সিরাজুদ্দিন হাক্কানি ছিলেন সন্ত্রাসের প্রতীক। আফগানিস্তানে মার্কিন বাহিনী এবং আফগান বেসামরিকদের বিরুদ্ধে অসংখ্য প্রাণঘাতী হামলার নেতৃত্ব দিয়েছেন তিনি। আফগানিস্তানের সবচেয়ে ভয়ংকর জঙ্গি থেকে তিনি এখন দেশটির তালেবান শাসনের মধ্যে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর নেতৃত্বাধীন হাক্কানি নেটওয়ার্ক এখন আফগানিস্তানের তালেবান শাসনের অংশীদার। নিউইয়র্ক টাইমস জানিয়েছে, ২০২১ সালে তালেবান বাহিনী আফগানিস্তানের ক্ষমতায় ফিরে আসার পর একজন বাস্তববাদী কূটনীতিক হিসাবে আবির্ভূত হন হাক্কানি। বিশেষ করে শেখ হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার নেতৃত্বে কট্টরপন্থী তালেবান সরকারের মধ্যে থেকেও তিনি মধ্যপন্থী দৃষ্টিভঙ্গির পক্ষে কথা বলা শুরু করেছিলেন। তা ছাড়া যুদ্ধের দিনগুলোতে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার চেষ্টাও করেছিলেন। এদিকে তালেবান শাসনের মধ্যে থেকে আফগানিস্তানে ইতিবাচক পরিবর্তন আনা সহজ বিষয় নয়। তালেবানের একজন জ্যেষ্ঠ নেতা হিসেবে সিরাজুদ্দিন হাক্কানি মেয়েদের ষষ্ঠ শ্রেণির বেশি পড়ার অনুমতি এবং সরকারে নারীদের কাজ করার অনুমতি দেওয়ার মতো নীতিগুলোর ওপর জোর দিয়ে আসছেন। পাশাপাশি তিনি ইউরোপ, রাশিয়া এবং চীন সহ বিভিন্ন জাতির সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে তিনি তালেবানের মধ্যে থাকা চরমপন্থী দলগুলোর প্রভাব কমানোরও চেষ্টা করছেন। তালেবান শাসনকে কিছুটা উদারপন্থী করতে গিয়ে তাঁর প্রচেষ্টা প্রায় সময়ই সংগঠনটির আমির শেখ হাইবাতুল্লাহ আখুন্দজাদার কট্টরপন্থী অবস্থানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া নিউইয়র্ক টাইমসের নিবন্ধটিতে আফগানিস্তানের অনমনীয় শাসনব্যবস্থায় সম্ভাব্য পরিবর্তনের সিরাজুদ্দিন হাক্কানিকেই আশার ঝলক হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
বাস্তবে এই ধরনের নিবন্ধগুলির মূল লক্ষ্য হচ্ছে বিভাজন তৈরি করা এবং কিছু মুজাহিদিনদেরকেকে মার্কিন স্বার্থের দিকে চালিত করা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগান মুজাহিদিনদের ঐক্যকে তার রাজনৈতিক, বুদ্ধিমত্তা এবং আদর্শিক প্রভাবের প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখে। অতএব, এটি তালেবানদেরকে “চরমপন্থী এবং খারাপ তালেবান” এবং “মধ্যপন্থী এবং ভাল তালেবান” হিসেবে বিভক্ত করতে চায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র “মধ্যপন্থী তালেবানদের সাথে জড়িত হতে চায় যাদেরকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র “নম্র এবং ভাল” বলে মনে করে।
পশ্চিমা রাজনীতিবিদ এবং মিডিয়া আফগানিস্তানের তালেবান শাসকদের ব্যাপারে যে শব্দগুলি ব্যবহার করছে সেগুলোকে খুব সহজ অর্থহীন হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। – এই শব্দগুলো ব্যবহারের পেছনে পশ্চিমাদের একটি উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক এজেন্ডা রয়েছে।ঔপনিবেশিক শক্তি ঐতিহাসিকভাবে তাদের আধিপত্যকে মজবুত করার জন্য প্রত্যেকের জন্য মিথ্যা পরিচয় তৈরি করে বিভিন্ন লেবেলে দলগুলোকে বিভক্ত করেছে। এটার লক্ষ্য হল প্রাথমিকভাবে জনগণের মনে বিভাজনের বীজ বপন করা এবং দীর্ঘমেয়াদে ‘সংঘাত ও ক্ষমতার লড়াইয়ের’ পথ প্রশস্ত করা। এই পদ্ধতিটি সুপরিচিত “ভাগ কর এবং শাসন কর” নীতির একটি স্পষ্ট উদাহরণ।
স্নায়ুযুদ্ধের সময়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র “চরমপন্থী” এবং “মধ্যপন্থী” কমিউনিস্ট দলগুলির মধ্যে পার্থক্য করার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করত এবং সোভিয়েত প্রভাব মোকাবেলা করার জন্য কমিউনিস্ট দেশগুলিতে “মধ্যপন্থী নেতাদের” সাথে যুক্ত হতে চাইছিল। এই কৌশলটি সোভিয়েত আমলে ফিলিস্তিন, সিরিয়া এবং আফগানিস্তানে মুজাহিদিনদের বিরুদ্ধেও কাজে লাগানো হয়েছিলন। তাদেরকে “মধ্যপন্থী” এবং “চরমপন্থী” এই ভাগে বিভক্ত করে মার্কিনীরা মধ্যপন্থীদের সাথে জড়িত হয়ে তাদের ইসলামী এজেন্ডাকে দুর্বল ও পথভ্রস্ট করেছিল। একইভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তানে পশ্চিমা ধর্মনিরপেক্ষ রুচির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ইসলামের একটি সংস্করণ বাস্তবায়নের এজেন্ডা হিসেবে তালেবান নেতৃত্বকে চরমপন্থী” এবং “মধ্যপন্থী” এই দুইভাবে ভাগ করে তালেবানের মধ্যপন্থী অংশটি যারা পশ্চিমা চাহিদা বাস্তবায়নে আগ্রহী হয়েছে তাদের সাথে সম্পর্ক ও যোগাযগ বৃদ্ধি করছে। এভাবে মার্কিনীরা মুজিহিদিনদের একটা অংশকে যাদের মধ্যে ইসলামী খিলাফত প্রতিষ্ঠা ও শরীয়াহর পূর্নাঙ্গ বাস্তবায়নের মাধ্যমে রাষ্ট্রের মৌলিক পরিবর্তনের আন্তরিক আকাংখা ও প্রচেস্টা ছিল সেটাকে পথভ্রস্ট করার চেস্টা করছে। আর আফগানিস্তানের জনগণের মধ্যে যে খিলাফতে রাশিদাহর অধীনে ইসলামী শরীয়া দিয়ে শাসনের আকাঙ্ক্ষা ছিল সেটাকেও হাইজ্যাক করার চেস্টা করছে পশ্চিমারা।
প্রকৃতপক্ষে, উপনিবেশবাদী পশ্চিমারা শুধুমাত্র আফগানিস্তানে নয় বরং বিশ্বব্যাপী মূসলিম ভূখন্ডগুলোতে আপামর জনসাধারণের মধ্যে ইসলাম দিয়ে শাসিত হওয়ার আকাংখাকেও এভাবে ছিনতাই করার চেস্টা করছে পশ্চিমাদের প্রতি আকৃষ্ট বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গদেরকে টার্গেট করার মাধ্যমে যারা পশ্চিমাদের লাইফস্টাইল ও তাদের জীবনাদর্শের প্রতি বিমোহিত । বাংলাদেশ সহ বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন গণআন্দোলনে স্বৈরশাসকদের পতন ও তৎপরবর্তী রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে জনগণের প্রকৃত পরিবর্তনের আকাংখাকে ভিন্ন দিকে প্রবাহিত করতে বিভিন্ন পশ্চিমা দেশের এম্বাসীগুলো কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে টার্গেট করে তাদেরকে ঐ দেশ এবং পশ্চিমের মধ্যে সেতু হিসাবে কাজ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করে এবং এই ব্যক্তিদেরকে “পরিবর্তনের সেরা আশা” -The best hope for change হিসেবে উপস্থাপন করে। এবং আমরা বাংলদেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নতুন কিংবা পুরনো রাজনীতিবিদদের অনেককেই পশ্চিমা দেশসমূহের দুতাবাসের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করতে এবং তাদের দুতাবাসের বিভিন্ন পার্টি ও ডিনারে অংশগ্রহণ করতে দেখেছি। কিন্তু এদেশের ছাত্র-জনতা গণঅভ্যুত্থান করেছে বৈষম্যমুক্ত ও বিদেশী আগ্রাসন ও প্রভাবমুক্ত সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টারের জরিপে উঠে এসেছিল যে বাংলাদেশের মুসলিমদের মধ্যে ৮২% শরীয়াহ আইনের পক্ষে। তাই অন্তর্বর্তী সরকার ও ছাত্র জনতাকে পশ্চিমা উপনিবেশবাদীদের ব্যাপারে সাবধানে অগ্রসর হতে হবে। তাদের পশ্চিমা পরামর্শ ও বিভিন্ন প্রেসক্রিপশনের ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত সকল উপনিবেশবাদবিরোধী, দেশপন্থী এবং ইসলামপন্থী শক্তিসমূহকে একত্রিত করে আমাদের শত্রুদের এবং তাদের স্থানীয় দালালদেরকে মোকাবেলা করার ব্যবস্থা করা যাতে ছাত্র-জনতার বিল্পবের আকাঙ্ক্ষা ও ইসলাম দিয়ে শাসিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা নস্যাৎ না হয়ে যায়।