কে এম শহীদ
শহীদ জেহাদের ছোট ভাই
১৯৯০ সাল থেকে, অক্টোবর মাস আমাদের পরিবারের জন্য বেদনার মাস। ৯০ সালের ১0ই অক্টোবর তৎকালীন স্বৈরাচার সরকার ছিনিয়ে নিয়েছিল আমাদের পরিবারের তথা উল্লাপাড়ার সর্বজন স্বীকৃত সম্ভাবনাময় উজ্জ্বল তরুণ প্রাণ আমার বড় ভাই বা সাথী কে এম নাজির উদ্দিন জেহাদকে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার ডাকে সাড়া দিয়ে সুদূর উল্লাপাড়া থেকে ৬০ জন সহযোদ্ধা নিয়ে এসেছিলেন সচিবালয় অবরোধ কর্মসূচি সফল করার উদ্দেশ্যে (আমিও ছিলাম এই অভিযানের একজন সেনানি।৯ই অক্টোবর ১৯৯০ সালে, অবরোধ কর্মসূচী সফলের উদ্দেশ্যে থানা সদরে মিছিল শেষ করে রাত্রিতে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হয় জেহাদ। ১০ অক্টোবর বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এসে পৌঁছে জেহাদের বহর।
আমাদের পরিবারের সবাই জানে জেহাদের রাজনীতির কথা। কিন্তু তার জনপ্রিয়তা বা গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে সবাই খুব বেশি অবগত ছিল না, আমি ছাড়া। আমার জানবার কারন হল আমি তার শুধু ছোট ভাই ছিলাম না অবিচ্ছেদ্য অংশও ছিলাম বটে। ছোট ভাই অর্থাৎ জিহাদ আমার জীবনের একটি অপরিহার্য অংশ ছিল। শত দুঃখ কষ্ট ও হাসি আনন্দ উপভোগ করেছি একই সাথে। আমাদের বয়সের পার্থক্য ৫ বছর হলেও ছোটবেলায় আমি ছোট ভাইকে জেহাদ বলেই ডাকতাম। এক সময়ে দুই ভাই, একসাথে ফুটবল খেলতে যেতাম বিভিন্ন টুর্নামেন্টে। পড়ালেখায় অত্যন্ত ভালো ছিলেন ছোট ভাই। আর আমি ছিলাম খেলাধুলায় ভালো। নিম্ন মধ্যবিত্ত দশ ভাইবোনের পরিবারের নবম ও দশম সন্তান আমরা। পরিবারের সকলের মঙ্গল আর জন্য এবং ছোটদের ভবিষ্যৎ নিশ্চিতের লক্ষ্যে আমাদের বড় ভাইকে কে এম বশির পাড়ি জমান জার্মানিতে আমাদের কিশোর অবস্থায় রেখে। পাঁচ বছর পর বড় ভাই জার্মানি থেকে ফিরে এসে আমার খেলাধুলায় প্রাপ্ত বিভিন্ন পুরুস্কার দেখে আমার স্বপ্ন তথা পরিবারের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আমাকে উল্লাপাড়া থেকে ঢাকায় জুনিয়র ব্রাদার্সের ফুটবল টিম এ ভর্তি করে দেয়। এভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ি আমরা দুই ভাই। ছোট ভাই নবম শ্রেণী থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়েন। বিভিন্ন রাজনীতির বই পড়তে দেখেছি আমি ছোট ভাইকে। হাই স্কুল থেকেই জড়িয়ে পড়েন মহান নেতা শহীদ জিয়ার প্রিয় সংগঠন ছাত্রদলের সাথে।
আমার যতটুকু মনে পড়ে উল্লাপাড়া তখন জাসদ ও আওয়ামীলীগ ছাত্রলীগের একছত্র আধিপত্যের মধ্যে ছিল। ছাত্রদলের কলেজ শাখায় ৮-১০ জন ছাড়া মিছিলে লোক হত না। তারপরও বৃহত্তর দুটি সংগঠনের বিভিন্ন প্রকার ভয় ভিত্তি উপেক্ষা করে হাইস্কুল থেকে বন্ধুদের নিয়ে কলেজে মিছিল করত। এভাবেই প্রবেশ করেন ছাত্র রাজনীতিতে। জেহাদ ছাত্র হিসেবে ভালো থাকার কারণে শিক্ষকবৃন্দ সহ বাকিদের মন জয় করেন অতি সহজে। পড়ালেখার সাথে রাজনীতি চর্চার পাশাপাশি সংস্কৃতি ও ক্রীড়াঙ্গনে ছোট ভাইয়ের একক আধিপত্য বিদ্যমান ছিল। এভাবে জেহাদ অতি অল্প বয়সে উল্লাপাড়া তথা সিরাজগঞ্জ জেলায় তরুণ সংগঠক হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেন। ছোট ভাইকে এত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন আমরা কেউ তা জানতাম না। উপস্থাপক হিসেবে জেলা পর্যায়ে যে কোন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব পেতেন। পাশাপাশি বিভিন্ন খেলার ধারা বর্ণনায় জেলায় তৃতীয় ছিলেন তিনি। ট্রেলার বিভিন্ন মাঠে খেলতে যেয়ে দেখেছি ছোট ভাইয়ের ফুটবলের ধারা বর্ণনা। আবার ক্রিকেটে ইংরেজি ও বাংলা ধারা বর্ণনায় তার ছিল সমান দক্ষতা। সর্বোপরি ছোটভাইয়ের বহুবিধক প্রতিভার সমন্বয়ের উদ্দেশ্য ছিল একটাই তার ছাত্রদলকে চাঙ্গা করা। জীবন দিয়ে সফল করে গেছেন তার আশা। ৯৩ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে জেহাদএর করা ছাত্রদল পূর্ণ প্যানেল জয়ী হয়।
আমার যতটুকু মনে পড়ে উল্লাপাড়া তখন জাসদ ও আওয়ামীলীগ ছাত্রলীগের একছত্র আধিপত্যের মধ্যে ছিল। ছাত্রদলের কলেজ শাখায় ৮-১০ জন ছাড়া মিছিলে লোক হত না
৯০ আর ৯ই অক্টোবর সকালে বাড়ি থেকে বের হওয়ার সময় মাকে বলেছিলেন মা আমি আজ ঢাকা যাব এবং আরও অনেকে যাবে স্বৈরাচার বিরুদ্ধে আন্দোলনে। মা তাকে ধমক দিয়ে বলেন তোমাকে ঢাকা যেতে হবে না। মায়ের অনুমতি আদায় করে দ্রুত ছুটে আসে উল্লাপাড়া থানা সদরে। সারাদিন যাবতীয় প্রস্তুতি শেষ করে রাত ৮:৩০ মিনিটে ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন সচিবালায় অবরোধ কর্মসূচিতে যোগদানের জন্য। যথারীতি ফজরের নামাজ পড়ে নেয় ধানমন্ডির কেন্দ্রীয় বিএনপি অফিসে। সকালের নাস্তা সেরে দলীয় নির্দেশ মোতাবেক যাত্রা শুরু করেন সাথী সহযোদ্ধাদের নিয়ে সচিবালয়ে অভিমুখে। কিন্তু পথেই বাধাপ্রাপ্ত হয়ে বাস থেকে নেমে রাজপথের অলিগলি ঘুরে এসে পড়েন বিএনপির মূলমঞ্চের কাছে।
“আমি এসেছিলাম সামরিক স্বৈরাচার সরকারের উৎখাতের আন্দোলনে, বুকে গুলি নিয়ে আমি মৃত্যু পথযাত্রী, আমি দেখে যেতে পারলাম না স্বৈরাচারের পতন, তবে আমার মৃত্যু তখনই সার্থক হবে তখনই আমার আত্মা শক্তি পাবে, যখন দেখবো আমাকে কেন্দ্র করে স্বৈরাচারের পতন ঘটবে-শহীদ জেহাদ”
এক পর্যায়ে দেখা গেল শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির ওপর স্বৈরাচারের লেলিয়ে দেয়া পেটোয়া বাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়ে দেশনেত্রী তথা জেহাদের সহ সারা বাংলার প্রিয় নেত্রী খালেদা জিয়ার ওপর। এ অবস্থা দেখে জেহাদের মত ছেলেরা তো বসে থাকতে পারে না। প্রতিবাদে প্রকম্পিত করে তোলে ঢাকার রাজপথ। এগিয়ে চলো স্বৈরাচারের দুর্গ আল্লাহ আল্লাহ ভবনের বর্তমান যুব ভবনের দিকে। স্বৈরাচারের দোসররা দিশেহারা হয়ে নির্বিচারে গুলি ছুটতে থাকে মিছিলের উপর। মিছিলের নেতৃত্বদানকারী আমার ভাই জেহাদ গুলিবিদ্ধ হয়। ঢাকার রাজপথ জেহাদ রক্তে রঞ্জিত হয়ে যায়। প্রকৃতিও এই বর্বরতা মেনে নিতে পারেনি। প্রবল প্রতিবাদে ফেটে পড়ে বাংলার মানুষ। বুকে গুলি নিয়ে সহযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বলে যান “আমি এসেছিলাম সামরিক স্বৈরাচার সরকারের উৎখাতের আন্দোলনে, বুকে গুলি নিয়ে আমি মৃত্যু পথযাত্রী, আমি দেখে যেতে পারলাম না স্বৈরাচারের পতন, তবে আমার মৃত্যু তখনই সার্থক হবে তখনই আমার আত্মা শক্তি পাবে, যখন দেখবো আমাকে কেন্দ্র করে স্বৈরাচারের পতন ঘটবে।”
মৃত্যুর পূর্বে বলে যাওয়া কথাগুলি তৎকালীন ছাত্রসমাজ তাদের জীবন বাজি রেখে পূরণ করেছেন। মৃত্যুর পূর্বে বলে যাওয়া কথাগুলো থেকে সহযোদ্ধারা, সাথীরা বুঝতে পেরেছিল জেহাদ কোন সাধারণ ছেলে নয়। তাই ছাত্ররা শত ঝুঁকি অত্যাচার নির্যাতন সহ্য করে স্বৈরাচারের হাতে যেতে দেয়নি আমার ভাইয়ের লাশ। ছোট ভাইয়ের লাশ ছাত্রসমাজ তৎকালীন ভিসি মনিরুজ্জামান মিয়ার কাছে হস্তান্তর করে এবং নেতৃবৃন্দ বলেন এই লাশ আমাদের জীবন থাকতে আমরা স্বৈরাচারের হাতে যেতে দেব না। এই লাশ জেহাদ আত্মীয় স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।
“যতদিন পর্যন্ত সামরিক সরকারের পতন না হবে ততদিন পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরে যাব না”-ভিপি আমান উল্লাহ আমান শপথ বাক্য পাঠ করান
এই অবস্থা থেকে তখনকার সকল ছাত্র নেতৃত্ববৃন্দ অলৌকিকভাবে জেহাদর লাশকে কেন্দ্র করে সকল দ্বন্দ্ব ভুলে গিয়ে সর্বদলীয় ছাত্র ঐক গড়ে তুলেন। আর মধ্যে শেখ হাসিনা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এসে উপস্থিত হন। সকল ছাত্র নেতৃবৃন্দ মনস্থির করেন শেখ হাসিনাই শপথ বাক্য পাঠ করাবেন। অপরাজয় বাংলার পাদদেশে শুরু হয় শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান। কিন্তু এক পর্যায়ে শেখ হাসিনা দলীয় স্লোগান দেওয়ার কারণে সকল ছাত্রনেত্রীবৃন্দের কাছে লাঞ্ছিত হয়ে অপরাজয় বাংলা ছাড়তে বাধ্য হয় ।তারপর সকল ছাত্র সংগঠন এক বাক্যে সম্মতি দেন ছাত্রদের নয়ন মনি সর্বজন গ্রহণযোগ্য ছাত্র নেতার ভিপি আমান উল্লাহ আমান শপথ বাক্য পাঠ করাবেন। আমান উল্লাহ আমানের নেতৃত্বে ছাত্র সমাজ শপথ নেয়। “যতদিন পর্যন্ত সামরিক সরকারের পতন না হবে ততদিন পর্যন্ত আমরা ঘরে ফিরে যাব না,” এই শপথ তৎকালীন ছাত্রসমাজ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। অতঃপর আসেন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বাংলার পাদদেশে ছাত্রসমাজের এই শপথের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে সকলকে সাহসের সাথে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান। সরকার শত হামলা নির্যাতনেও যখন আন্দোলন থামাতে ব্যর্থ হয়, তখন ছাত্র সমাজে কোটি কোটি টাকার প্রস্তাব পাঠায় আন্দোলন বন্ধ করার জন্য। কিন্তু জেহাদ লাশ নিয়ে যে ইস্পাত কঠিন শপথ নিয়েছিল ছাত্র সমাজ তা থেকে এক বিন্দু ও বিচ্যুতি হয়নি তারা।
বাংলাদেশের ইতিহাসে ছাত্র সমাজের অনেক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের মধ্যে দশ অক্টোবর ও একটি উজ্জ্বল ইতিহাস হয়ে আছে দেশবাসীর হৃদয়ে। শহীদ পরিবারের পক্ষ থেকে একটি অনুরোধ রাখছি কোন প্রকার রাজনৈতিক কারণে যেন তুলন্ঠিত না হয় ৯০ এর দশে অক্টোবর তথা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ইতিহাস।